‘লালসালু’ উপন্যাসের সমাজ-বাস্তবতা এবং সমাজচিত্র pdf download

একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি 
বাংলা সহপাঠ গাইড 
উপন্যাস 
লালসালু 
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ 

Social reality and social image of 'Lalsalu' novel pdf download
.
লালসালু উপন্যাসের কাহিনি-সংক্ষেপ, প্রধান চরিত্র ও নামকরণের সার্থকতা গাইড

‘লালসালু’ উপন্যাসের সমাজ-বাস্তবতাঃ

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’। রচনাটিকে একজন প্রতিভাবান লেখকের দুঃসাহসী প্রচেষ্টার সার্থক ফসল বলে বিবেচনা করা হয়। ঢাকা ও কলকাতার মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবন তখন নানা ঘাত-প্রতিঘাতে অস্থির ও চঞ্চল।

ব্রিটিশ শাসনবিরোধী আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মন্বন্তর, সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশবিভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, আবার নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান গড়ে তোলার উদ্দীপনা ইত্যাদি নানা রকম সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আবর্তে মধ্যবিত্তের জীবন তখন বিচিত্রমুখী জটিলতায় বিপর্যস্ত ও উজ্জীবিত। নবীন লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, এই চেনা জগৎটাকে বাদ দিয়ে তাঁর প্রথম উপন্যাসের জন্য গ্রামীণ পটভূমি ও সমাজে-পরিবেশ বেছে নিলেন।

আমাদের দেশ ও সমাজ মূলত গ্রামপ্রধান। এদেশের বেশিরভাগ লোকই গ্রামে বাস করে। এই বিশাল গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবন দীর্ঘকাল ধরে অতিবাহিত হচ্ছে নানা অপরিবর্তনশীল তথাকথিত অনাধুনিক বৈশিষ্ট্যকে আশ্রয় করে। এই সমাজ থেকেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বেছে নিলেন তাঁর উপন্যাসের পটভূমি, বিষয় এবং চরিত্র। তাঁর উপন্যাসের পটভূমি গ্রামীণ সমাজ; বিষয় সামাজিক রীতি-নীতি ও প্রচলিত ধারণা বিশ্বাস, চরিত্রসমূহ একদিকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মভীরু, শোষিত,দরিদ্র গ্রামবাসী, অন্যদিকে শঠ, প্রতারক ধর্মব্যবসায়ী এবং শোষক-ভূস্বামী।

‘লালসালু’ একটি সামাজিক সমস্যামূলক উপন্যাস। এর বিষয়: যুগ-যুগ ধরে শেকড়গাড়া কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ভীতির সঙ্গে সুস্থ জীবনাকাক্সক্ষার দ্বন্দ্ব। গ্রামবাসীর সরলতা ও ধর্মবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ী মজিদ প্রতারণাজাল বিস্তারের মাধ্যমে কীভাবে নিজের শাসন ও শোষণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে তারই বিবরণে সমৃদ্ধ ‘লালসালু’ উপন্যাস। কাহিনিটি ছোট, সাধারণ ও সামান্য কিন্তু এর গ্রন্থনা ও বিন্যাস অত্যন্ত মজবুত। লেখক সাধারণ একটি ঘটনাকে অসামান্য নৈপুণ্যে বিশ্লেষণী আলো ফেলে তাৎপর্য-মণ্ডিত করে তুলেছেন।

শ্রাবণের শেষে নিরাক পড়া এক মধ্যাহ্নে মহব্বতনগর গ্রামে মজিদের প্রবেশের নাটকীয় দৃশ্যটির মধ্যেই রয়েছে তার ভণ্ডামি ও প্রতারণার পরিচয়। মাছ শিকারের সময় তাহের ও কাদের দেখে যে, মতিগঞ্জ সড়কের ওপর একটি অপরিচিত লোক মোনাজাতের ভঙ্গিতে পাথরের মূর্তির মতোন দাঁড়িয়ে আছে। পরে দেখা যায়, ওই লোকটিই গ্রামের মাতব্বর খালে ব্যাপারীর বাড়িতে সমবেত গ্রামের মানুষকে তিরষ্কার করছে? ‘আপনারা জাহেল, বেএলেম, আনপাড়হ্।

মোদাচ্ছের পিরের মাজারকে আপনারা এমন করি ফেলি রাখছেন?’ অলৌকিকতার অবতারণা করে মজিদ নামের ওই ব্যক্তি জানায় যে, পিরের স্বপ্নাদেশে মাজার তদারকির জন্যে তার এ গ্রামে আগমন। তার তিরষ্কার ও স্বপ্নাদেশের বিবরণ শুনে গ্রামের মানুষ ভয়ে এবং শ্রদ্ধায় এমন বিগলিত হয় যে তার প্রতিটি হুকুম তারা পালন করে গভীর আগ্রহে। গ্রামপ্রান্তের বাঁশঝাড়সংলগ্ন কবরটি দ্রুত পরিচ্ছন্ন করা হয়।

ঝালরওয়ালা লালসালুতে ঢেকে দেওয়া হয় কবর। তারপর আর পিছু ফেরার অবকাশ থাকে না। কবরটি অচিরেই মাজারে এবং মজিদের শক্তির উৎসে পরিণত হয়। যথারীতি সেখানে আগরবাতি, মোমবাতি জ্বলে; ভক্ত আর কৃপাপ্রার্থীরা সেখানে টাকা পয়সা দিতে থাকে প্রতিদিন। কবরটিকে মোদাচ্ছের পিরের বলে শনাক্তকরণের মধ্যেও থাকে মজিদের সুগভীর চাতুর্য।

মোদাচ্ছের কথাটির অর্থ নাম-না-জানা। মজিদের স্বগত সংলাপ থেকে জানা যায়, শস্যহীন নিজ অঞ্চল থেকে ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে পড়া মজিদ নিজ অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে এমন মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। আসলে এই প্রক্রিয়ায় ধর্ম ব্যবসায়ীদের আধিপত্য বিস্তারের ঘটনা এ দেশের গ্রামাঞ্চলে বহুকাল ধরে বিদ্যমান। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ গ্রামীণ সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক যথাযথভাবেই এখানে তুলে ধরেছেন।

মাজারের আয় দিয়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মজিদ ঘরবাড়ি ও জমিজমার মালিক হয়ে বসে এবং তার মনোভূমির এক অনিবার্য আকাক্সক্ষায় শক্ত-সমর্থ লম্বা চওড়া একটি বিধবা যুবতীকে বিয়ে করে ফেলে। আসলে স্ত্রী রহিমা ঠাণ্ডা ভীতু মানুষ। তাকে অনুগত করে রাখতে কোনো বেগ পেতে হয় না মজিদের। কারণ, রহিমারও মনেও রয়েছে গ্রামবাসীর মতো তীব্র খোদাভীতি।

স্বামী যা বলে, রহিমা তাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে। রহিমার বিশ্বাস তার স্বামী অলৌকিক শক্তির অধিকারী। প্রতিষ্ঠা লাভের সাথে সাথে মজিদ ধর্মকর্মের পাশাপাশি সমাজেরও কর্তা-ব্যক্তি হয়ে ওঠে। গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন জীবনে উপদেশ নির্দেশ দেয়-গ্রাম্য বিচার-সালিশিতে সে-ই হয়ে ওঠে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী প্রধান ব্যক্তি। এ ক্ষেত্রে মাতব্বর খালেক ব্যাপারীই তার সহায়ক শক্তি। ধীরে ধীরে গ্রামবাসীর পারিবারিক জীবনেও নাক গলাতে থাকে সে।

তাহেরের বাপ-মার মধ্যেকার একান্ত পারিবারিক বিবাদকে কেন্দ্র করে তাহেরের বাপের কর্তৃত্ব নিয়েও সে প্রশ্ন তোলে। নিজ মেয়ের গায়ে হাত তোলার অপরাদে হুকুম করে মেয়ের কাছে মাফ চাওয়ার এবং সেই সঙ্গে মাজারের পাঁচ পয়সার সিন্নি দেয়ার। অপমান সহ্য করতে না পেরে তাহেরের বাপ শেষ পর্যন্ত নিরুদ্দেশ হয়। খালেক ব্যাপারীর নিঃসন্তান প্রথম স্ত্রী আমেনা সন্তান কামনায় অধীর হয়ে মজিদের প্রতিদ্বন্দ্বী। পিরের প্রতি আস্থাশীল হলে মজিদ তাকেও শাস্তি দিতে পিছপা হয় না।

আমেনা চরিত্রে কলঙ্ক আরোপ করে খালেক ব্যাপারীকে দিয়ে তাকে তালাক দিতে বাধ্য করে মজিদ। কিন্তু তবু মাজার এবং মাজারের পরিচালক ব্যক্তিটির প্রতি আমেনা বা তার স্বামী কারুরই কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হয় না।

গ্রামবাসী যাতে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে মজিদের মাজারকেন্দ্রিক পশ্চাৎপদ জীবন ধারা থেকে সরে যেতে না পারে, সে জন্য সে শিক্ষিত যুবক আক্কাসের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে।  সে আক্কাসের স্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। মজিদ এমনই কূট-কৌশল প্রয়োগ করে সে আক্কাস গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। এভাবে একের পর এক ঘটনার মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক গ্রাম, সমাজ ও মানুষের বাস্তব-চিত্র ‘লালসালু’ উপন্যাসে ফুটিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসটি শিল্পিত সামাজিক দলিল হিসেবে বাংলা সাহিত্যের একটি অবিস্মরণীয় সংযোজন।

‘লালসালু’র প্রধান উপাদান সমাজ-বাস্তবতা। গ্রামীণ সমাজ এখানে অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থবির, যুগযুগ ধরে এখানে সক্রিয় এই অদৃশ্য শৃঙ্খল। এখানকার মানুষ ভাগ্য ও অলৌকিকত্ব গভীরভাবে বিশ্বাস করে। দৈবশক্তির লীলা দেখে নিদারুণ ভয় পেয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখে নয়তো ভক্তিতে আপ্লুত হয়। কাহিনির উন্মোচন-মুহূর্তেই দেখা যায়, শস্যের চেয়ে টুপি বেশি। যেখানে ন্যাংটা থাকতেই বাচ্চাদের আমসিপারা শেখানো হয়। শস্য যা হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য।

সুতরাং ওই গ্রাম থেকে ভাগ্যের সন্ধানে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে যে-গ্রামে গিয়ে বসতি স্থাপন করতে চায় সেই গ্রামেও একইভাবে কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের জয়-জয়কার। এ এমনই এক সমাজ যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে কেবলই শোষণ আর শোষণ- কখনো ধর্মীয়, কখনো অর্থনৈতিক। প্রতারণা, শঠতা আর শাসনের জটিল এবং সংখ্যাবিহীন শেকড় জীবনের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত পরতে পরতে ছড়ানো। আর ওইসব শেকড় দিয়ে প্রতিনিয়ত শোষণ করা হয় জীবনের প্রাণরস।

আনন্দ, প্রেম, প্রতিবাদ, সততা-এই সব বোধ এবং বুদ্ধি ওই অদৃশ্য দেয়ালে ঘেরা সমাজের ভেতরে প্রায়শ ঢাকা পড়ে থাকে। এই কাজে ভূস্বামী, জোতদার এবং ধর্মব্যবসায়ী একজন আর একজনের সহযোগী। কারণ স্বার্থের ব্যাপারে তারা একাট্টা-পথ তাদের এক। একজনের আছে মাজার, অন্যজনের আছে জমিজোত প্রভাব প্রতিপত্তি। দেখা যায়, অন্য কোতাও নয় আমাদের চারপাশেই রয়েছে এরূপ সমাজের অবস্থান। বাংলাদেশের যে-কোনো প্রান্তের গ্রামাঞ্চলে সমাজের ভেতর ও বাইরের চেহারা যেন এরূপ একই রকম।

আবার এই বদ্ধ, শৃঙ্খলিত ও স্থবির সামাজিক অবস্থার একটি বিপরীত দিকের চিত্রও আছে। তা হলো, মানুষের প্রাণধর্মের উপস্থিতি। মানুষ ভালোবাসে, স্নেহ করে; কামনা-বাসনা এবং আনন্দ-বেদনায় উদ্বেলিত হয়। নিজের স্বাভাবিক ইচ্ছা ও বাসনার কারণে সে নিজেকে আলোকিত ও বিকশিত করতে চায়। কোনো ক্ষেত্রে যদি সাফল্য ধরা না-ও দেয় তবু কিন্তু স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা বেঁচে থাকে। প্রজন্ম পরম্পরায় চলতে থাকে তার চাওয়া ও না-পাওয়ার সাংঘর্ষিক রক্তময় হৃদয়ার্তি। এটা অব্যাহত থাকে মানব সম্পর্কের মধ্যে, দৈনন্দিন ও পারিবারিক জীবনে, এমনকি ব্যক্তি ও সমষ্টির মনোলোকেও।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ মানবতাবাদী লেখক। মানব-মুক্তির স্বাভাবিক আকাক্সক্ষা তাঁর সাহিত্য সাধণার কেন্দ্রে সক্রিয়। এ দেশের মানুষের সুসংগত ও স্বতঃস্ফ‚র্ত বিকাশের অন্তরায়গুলিকে তিনি তাঁর রচিত সাহিত্যের পরিমণ্ডলেই চিহ্নিত করেছেন; দেখিয়েছেন কুসংস্কারের শক্তি আর অন্ধবিশ্বাসের দাপট। স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি ও সমাজ সরল ও ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষকে কীভাবে বিভ্রান্তি ও ভীতির মধ্যে রেখে শোষণের প্রক্রিয়া চালু রাখে তার অনুপুঙ্খ বিবরণ এবং ধর্মের নামে প্রচলিত কুসংস্কার, গোঁড়ামি ও অন্ধত্ব।

তিনি সেই সমাজের চিত্র তুলে ধরেন যেখানে ‘শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি’। তিনি মনে করেন, ধর্ম মানুষকে সত্যের পথে, কল্যাণের পথে, পারস্পরিক মমতার পথে নিয়ে এসেছে; কিন্তু ধর্মের মূল ভিত্তিটাকেই দুর্বল করে দিয়েছে কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাস। এ কারণে মানুষের মন আলোড়িত, জাগ্রত ও বিকশিত তো হয়ইনি বরং দিন দিন হয়েছে দুর্বল, সংকীর্ণ এবং ভীত। স্বার্থ ও লোভের বশবর্তী হয়ে এক শ্রেণির লোক যে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখার জন্য নানা ভণ্ডামি ও প্রতারণার আশ্রয় নেয় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর আঘাত তার বিরুদ্ধে। লেখক সামাজিক এই বাস্তবতার চিত্রটিই এঁকেছেন ‘লালসালু’ উপন্যাসে; উন্মোচন করেছেন প্রতারণার মুখোশ।

অত্যন্ত যত্ন নিয়ে রচিত একটি সার্থক শিল্পকর্ম ‘লালসালু’ উপন্যাস। এর বিষয় নির্বাচন, কাহিনি ও ঘটনাবিন্যাস গতানুগতিক নয়। এতে প্রাধান্য নেই প্রেমের ঘটনার, নেই প্রবল প্রতিপক্ষের প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্বসংঘাতের উত্তেজনাকর ঘটনা উপস্থাপনের মাধ্যমে চমক সৃষ্টির চেষ্টা। অথচ মানবজীবনের প্রকৃত রূপ আঁকতে চান তিনি। মানুষের অন্তর্ময় কাহিনি বর্ণনা করাই লক্ষ্য তাঁর।

ফলে চরিত্র ও ঘটনার গূঢ় রহস্য, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তাঁকে দেখাতে হয়েছে যা জীবনকে তার অন্তর্গত শক্তিতে উজ্জীবিত ও উদ্দীপ্ত করে। যে ঘটনা বাইরে ঘটে তার অধিকাংশেরই উৎস মানুষের মনে লোভ, ঈর্ষা, লালসা, বিশ্বাস, ভয়, প্রভুত্ব কামনাসহ নানরূপ প্রবৃত্তি। বাসনাবেগ ও প্রবৃত্তি মানুষের মনে সুপ্ত থাকে বলেই বাইরের বিচিত্র সব ঘটনা ঘটাতে তাকে প্ররোচিত করে। ধর্ম-ব্যবসায়ীকে মানুষ ব্যবসায়ী হিসেবে শনাক্ত করতে না পেরে ভয় পায়।

কারণ, তাদের বিশ্বাস লোকটির পেছনে সক্রিয় রয়েছে রহস্যময় অতিলৌকিক কোনো দৈবশক্তি। আবার ধর্ম-ব্যবসায়ী ভণ্ড ব্যক্তি যে নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ বোধ করে তা নয়, তার মনেও থাকে সদা ভয়, হয়ত কোনো মানুষ স্বাভাবিক প্রেরণা ও বুদ্ধির মাধ্যমে তার গড়ে তোলা প্রতিপত্তির ভিত্তিটাকে ধসিয়ে দেবে। নরনারীর অবচেতন ও সচেতন মনের নানান ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াই এভাবে লেখকের বিষয় হয়ে উঠেছে ‘লালসালু’ উপন্যাস।

‘লালসালু’ উপন্যাসে প্রতিফলিত সমাজচিত্রঃ

‘লালসালু’ উপন্যাসটি যদিও বিশ শতকের প্রথমার্ধে রচনা, তবু সামগ্রিক বিবেচনায় এই উপন্যাসটি সব কালেই সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তার প্রধান কারণ এই যে, এ উপন্যাসে কাল খুব একটা স্পষ্ট রেখায় অঙ্কিত হয়নি, যতটা স্পষ্ট করে অঙ্কিত হয়েছে সমাজ ও জীবনের রূপায়ণ।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর ‘লালসালু’ উপন্যাসে গ্রামীণ বাংলার সমাজ ও জীবনের যে-চিত্র আমাদের সামনে উন্মোচন করেছেন, তা আমাদের অনেক চেনা; বলা যায়, আবহমান কাল ধরে চেনা, এবং এই চেনা কুসংস্কারাচ্ছন্ন বাংলার সমাজ ও জীবন যে গত পাঁচ শ বছরে খুব একটা বদলেছে এমন নয়-গ্রামীণ পটভূমিতে তো নয়ই। তাই, এ কথা আমরা দ্বিধাহীনভাবেই বলতে পারি, ‘লালসালু’ উপন্যাসে ছায়াপাতে আবহমান কালের গ্রামীণ বাংলার জনজীবন ও সমাজের রূপায়ণে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ যথেষ্ট সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এমন একটি সমাজের চিত্র অঙ্কন করেছেন, যেটি স্মরণাতীত কাল থেকে কুসংস্কারের জটাজালে আচ্ছন্ন। লালসালু কাপড় দিয়ে মাজার ঢেকে রেখে যেমন ধর্মব্যবসায়ীরা যুগের পর যুগ ধর্মপ্রাণ অশিক্ষিত মানুষদের ধোঁকা দিয়ে আসছে এবং কুসংস্কারের ভারী চাদরে মোড়ানো গ্রামীণ বাংলাদেশের সমাজের পরতে পরতে অন্ধত্ব ও প্রথাবদ্ধতা কী রকম অশুভ ছায়া বিস্তার করেছিল, সেটাই মূলত ওয়ালীউল্লাহ তাঁর এ মহান উপন্যাসের মধ্য দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছেন।

লেখকের মূল অবলম্বন হচ্ছে কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ। ধর্মব্যবসায়ের সে-ই হোতা। তাকে আপাতভাবে সহায় সম্বলহীন হিসেবে অঙ্কন করলেও সে অত্যন্ত ধুরন্ধর, শঠ ও নিপীড়ক। এ উপন্যাসের সমাজচিত্র অঙ্কনে লেখক মজিদ চরিত্রের মনোজাগতিক অনুভব ও তার চিন্তারাশিকেই মূল সহায় হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

অন্যভাবে আমরা বলতে পারি, মজিদই এ উপন্যাসে লেখকের প্রতিনিধি চরিত্র-প্রতিনিধি এই অর্থে, লেখক মজিদের চোখেই মহব্বতনগর ও আওয়ালপুরের গ্রামের জনজীবনকে প্রত্যক্ষ করেছেন, অনুভব করেছেন সে কালের মানুষের হৃদস্পন্দন আপন হৃদয়ে। মজিদ নিঃসন্দেহে একটি নেতিবাচক চরিত্র; তবু সে ‘লালসালু’ উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সমাজ ও জীবনের অভিজ্ঞতার ফসল-অপপুত্র হলেও মজিদ ওয়ালীউল্লাহর মানস সন্তান।

‘লালসালু’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রথম উপন্যাস। আমরা জানি, তিনি আজন্ম শহরে থেকেছেন, অভিজাত শিক্ষিত পরিবারের সন্তান। নাগরিক রুচি ও মননের অধিকারী হলেও তিনি শহরকেন্দ্রিক কোনো উপন্যাস লেখেননি। মাত্র তিনটি উপন্যাস তিনি রচনা করেছেন। তিনটির পটভূমিই গ্রামে সংস্থাপিত।

এর কারণ হিসেবে সমালোচকগণ জানিয়েছেন, গ্রামীণ সমাজ ও সংস্কৃতির মর্মমূলে যুগ যুগ ধরে যে কুংসংস্কার গ্রোথিত আছে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ মূলত সেই কুসংস্কারের শিকড় উপড়ে ফেলার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। শওকত আলী বলেছেন: “তাঁর উপন্যাসের পটভূমি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল এবং তার সমাজ-চরিত্র, একদিকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মভীরু শোষিত দরিদ্র গ্রামবাসী; অন্যদিকে শঠ, প্রতারক ধর্মব্যবসায়ী এবং শোষক ভূস্বামী। তাঁর উপন্যাসের বিষয় যুগ যুগ ব্যাপী শিকড়-গাড়া কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ভীতির সঙ্গে সুস্থ জীবনাকাক্সক্ষার দ্বন্দ্ব।”

‘লালসালু’তে আমরা গ্রামীণ বাংলাদেশকে মূর্ত হয়ে উঠতে দেখি। নাগরিক বিদগ্ধ লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এক মুহূর্তে আমাদের ভিন্ন এক জগতে নিয়ে যান, যে জগৎ তাঁর বাস্তব পরিচিত ছিল কিনা জানি না, কিন্তু আমাদের অপরিচিত নয়। এমন এক গ্রাম মহব্বতনগর। সবাই সেখানে সব কাজের মধ্যে দৈব শক্তির লীলা দেখতে পায়। এ দৈব শক্তি আবার এমন দৈব শক্তি যা কিনা আবার মাজারের ভেতরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন একজন মোদাচ্ছের পীর।

পীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করে শেষ করবার মতো নয়। পীরের মাজারের যিনি খাদেম, তিনিও কম যান না। তাকেও কেবল দণ্ডমুণ্ডের কর্তাই কেবল ভাবা হয়নি, প্রাণসংহারক এমনকি প্রাণদাতাও কল্পনা করা হয়েছে। রহিমার মাধ্যমে হাসুনির মা যখন আর্জি পেশ করে, “ওনারে কইবেন, আমার যেন মওত হয়” অথবা খ্যাংটা বুড়ী মাজারে এসে তার সর্বস্ব আনা পাঁচেক পয়সা মজিদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে আর্তনাদ করে বলে, “সব দিলাম আমি, সব দিলাম।

পোলাটার এইবার জান ফিরাইয়া দেন।” তখন আমাদের বুঝতে কোনো কষ্টই হয় না যে মহব্বতনগর গ্রামের মানুষ এতটাই কুসংস্কারাচ্ছন্ন যে, তারা মনে করে মজিদ চাইলে যে কারও মৃত্যুর ব্যবস্থা করে দিতে পারে, অথবা চাইলেই মৃত মানুষকে ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা রাখে। অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারের চাদরে মোড়ানো সে সমাজ- যে সমাজের প্রতিভূ ধর্মব্যবসায়ী মজিদ এবং ভূস্বামী খালেক ব্যাপারী হাতে হাত মিলিয়ে দুঃশাসন চালিয়ে গেছে।

এদের কাছে যারা মাথা নত করে নি, তাদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠেছে। যেমন তাহের-কাদেরের বাবাকে গৃহত্যাগ করতে হয়েছে, আওয়ালপুরের পীর সাহেবকে পিছু হঠতে হয়েছে, আক্কাসের স্কুল প্রতিষ্ঠা সফল হয়নি। সুতরাং, আমরা বলতেই পারি, ‘লালসালু’ উপন্যাসে আমরা এমন এক সমাজের সাথে পরিচিত হই, যে সমাজ আবহমান কালের কুসংস্কারের তামাসায় আচ্ছন্ন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘জীবন ও সাহিত্য’ গ্রন্থে সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন।

“........যুগ যুগ ধরে এ নরম মাটির ধর্মভীরু মানুষের মনটিও নরম; এ মাটির শাসক-শোষক শ্রেণির অন্যতম হলো ধর্ম-ব্যবসায়ী স¤প্রদায়, তাদের কাছে মানুষের দুর্বলতাই বড় পুঁজি। ‘লালসালু’র কাহিনিটি ওপরে ওপরে এমনি একটি ভুঁইফোড় মাজার -কেন্দ্রিক গল্প কিন্তু ভিতরে-ভিতরে গ্রামের বাঙালি মুসলমান সমাজ জীবনের আলেখ্য।”

তবে এর বিপরীত চিত্রও ‘লালসালু’তে বিদ্যামান। মজিদের চাপিয়ে দেওয়া কুসংস্কারভিত্তিক প্রথাধর্মের আবরণ ভেদ করে মহব্বতনগর গ্রামের মানুষ প্রায়শই বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছে। সেটা তাদের স্বতঃর্স্ফূত প্রাণধর্মের বিকাশ। এমনিতে তারা ধর্মকর্ম বিশেষ একটা করে না, যতটা মগ্ন থাকে আনন্দ ফ‚র্তিতে। খরার দিনে জমিতে যখন ফাটল ধরে, তখন আল্লাহর নাম নেয়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর উপন্যাসে প্রথাধর্মের সাথে প্রাণধর্মের চিরন্তন দ্বন্দ্ব দেখিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত প্রাণধর্মের পক্ষ নিয়ে তার জীবন নিশ্চিত করেছেন।

‘লালসালু’ উপন্যাসে বিধৃত সমাজ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দুটি বিতর্ক এড়ানো সম্ভব হয় না। প্রথমটি হচ্ছে, লেখকের আক্রমণের লক্ষ্য কী ছিল? -ধর্ম, নাকি ধর্মের নামে প্রচলিত কুসংস্কার? দ্বিতীয়টি হলো, সমাজপতি খালেক ব্যাপারী চরিত্রটি এরূপে অঙ্কিত হয়েছে কেন? এটি কি লেখকের পরিকল্পিত ইচ্ছাকৃত কোনো সম্পাদিত বাস্তবতা, নাকি গ্রামীণ সমাজ ও জীবন সম্পর্কে লেখকের অনভিজ্ঞতার অভাবে এমনটি হয়েছে?

যেহেতু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এমন এক সমাজের গল্প বলেছেন, যে সমাজে ‘শস্যের চেয়ে টুপী বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি’- সুতরাং, তার আক্রমণের লক্ষ্য ধর্ম নয়, ধর্মের নামে প্রচলিত কুসংস্কার। ধর্ম চিরদিনই মানুষকে সত্য সুন্দর ও কল্যাণের পথ দেখিয়ে এসেছে কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থকে হাসিল করার অসৎ উদ্দেশ্যে ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্মের নামে কুসংস্কার, মাজার-পূজা ও অন্ধবিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে এসেছে এবং তারা তা বাস্তবায়ন করার জন্য নিরন্তরভাবে করে যাচ্ছে নানা ছলাকলা, কায়দা-কানুন।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আঘাত করেছেন এই শ্রেণিটিকে-ধর্মকে নয়। তবে বিতর্ক এই কারণে ওঠে যে, তার উপন্যাসে শুদ্ধ ধার্মিক কোনো চরিত্র মর্যাদার সঙ্গে অঙ্কিত হয়নি-ধর্ম ও ধর্মসংশ্লিষ্ট চরিত্রগুলো সবই নেতিবাচকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।

খালেক ব্যাপারী, স্পষ্টতই লেখকের বৃত্তের বাইরে যাওয়ার সঙ্গে যতটা সম্পর্কিত, তার পরিকল্পনার স্বাক্ষর ততটা বহন করে না। সমাজপতি এবং সেই সমাজের ধর্মীয় নেতার স্বার্থ অভিন্ন হয়-এটি অর্থতত্ত্বে বলে, সমাজবিজ্ঞানে বলে, ইতিহাসে আছে।

খালেক ব্যাপারী ও মজিদের স্বার্থ অভিন্ন। তারা দুজন একে অপরের পরিপূরক, কিন্তু সমাজপতি কখনই ধর্মীয় নেতা দ্বারা পরিচালিত হয় না। কারণ, অর্থ সমাজের অবকাঠামো নির্মাণ করে, ধর্ম হচ্ছে যার ক্ষুদ্র একটি বহির্কাঠামো মাত্র।

কাজেই খালেক ব্যাপারী চরিত্র নির্মিতিতে ব্যর্থতার পেছনে অর্থশাসিত সমাজ-বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজ, বাস্তব জীবনে লেখক যে সমাজকে খুব কাছে থেকে দেখেননি, তার অনভিজ্ঞতা একটি বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post