সিরাজউদ্দৌলা নাটকের চরিত্র আলোচনাঃ সিরাজউদ্দৌলা pdf download

একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি 
বাংলা সহপাঠ গাইড 
নাটক 
সিরাজউদ্দৌলা 
সিকান্দার আবু জাফর 
Character discussion of Sirajuddaula play: Sirajuddaula pdf download.

চরিত্রঃ সিরাজউদ্দৌলা

ভূমিকা: সিকান্দার আবু জাফরের ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের নায়ক সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। এ তরুণ নবাবকে স্বার্থান্ধ স্বদেশী ষড়যন্ত্রকারী এবং ক্ষমতা ও অর্থলোভী বিদেশি চক্রান্তকারীদের সম্মিলিত শঠতা, দুরভিসন্ধি ও শক্তির মোকাবেলা করতে হয়েছে এবং এ মোকাবেলা প্রচেষ্টার কাহিনি ও তাঁর করুণ পরিণতিই বিধৃত হয়েছে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে। তাঁর চরিত্রে সমাবেশ ঘটেছিল বহু বিরল গুণের। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা, নীতিবান, সাহসী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, বিবেচক, ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও সর্বোপরি স্বদেশপ্রেমিক।

সিরাজউদ্দৌলা নাটকের চরিত্র আলোচনাঃ সিরাজউদ্দৌলা

আপসকামী: সিরাজ মসনদে আরোহণ করার সময় চিরাচরিত প্রথায় নজরানা পাঠানো থেকে বিরত থাকলেও তিনি বার বার ইংরেজদের সাথে আপস করার চেষ্টা করেন। কারণ তিনি জানতেন যে, ঘসেটি বেগম তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন। কিন্তু নবাবের আপোসকামিতা অর্থলোভী ইংরেজ কোম্পানির লোকদের স্পর্ধা বাড়াতে থাকে। তারা কাশিমবাজার কুঠিতে গোপনে অস্ত্র আমদানি করে, কলকাতার আশেপাশে গ্রামের পর গ্রাম দখল করে, ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ সংস্কার করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে এবং নবাবের আদেশ লঙ্ঘন করে কৃষ্ণবল্লভকে আশ্রয় দেয়। এভাবে ধৃষ্টতা ও অনাচার যখন চরমে পৌঁছে তখন নবাব কোম্পানির বিরুদ্ধে সামরিক দেওয়ান নিযুক্ত করেন, মুক্তি দেন উমিচাঁদকে এবং কোম্পানির কর্মচারী হলওয়েল, ওয়াট্স ও কলেটকে রাজধানীতে পাঠাবার নির্দেশ দেন।

কৌশলী: গভর্নর ড্রেক, ক্যাপটেন ক্লেটন প্রমুখ ইংরেজ পালিয়ে সঙ্গীদেরসহ ভাগিরথী নদীবক্ষে ফোর্ট উইলিয়াম জাহাজে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং শোচনীয় জীবনযাপন করতে থাকেন। অর্থলোভী উমিচাঁদ ঘুষের বিনিময়ে বিশ্বাসঘাতক মানিকচাঁদের কাছ থেকে কলকাতার ইংরেজদের ব্যবসার অনুমতি আদায় করে তা ফোর্ট উইলিয়াম জাহাজে পাঠিয়ে দেয়। নবাব এ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। ওদিকে নবাবও নানা ওয়াদা আদায় করে হলওয়েল ও ওয়াটসকে মুক্তি দেন। নবাবের উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজদের তাঁর ক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত করা ও তাদের ক্ষমতা খর্ব করা, তাদের ব্যবসা সমূলে উচ্ছেদ করা নয়; তাই তিনি বন্দিদের মুক্তি দেন।

তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী: উভয় স্বার্থান্বেষী পক্ষ অপদার্থ শওকতজঙ্গকে মসনদে বসাতে তৎপর হয়। ঘসেটি বেগমের মতিঝিলের প্রাসাদে যখন সব পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়ে আসে তখন মোহনলালকে নিয়ে নবাব সেখানে উপস্থিত হন। তিনি জানান, শওকতজঙ্গকে বিদ্রোহী ঘোষণা করে তার বিরুদ্ধে অভিযানের আদেশ দিয়েছেন। তারপর তিনি ঘসেটি বেগমকে তাঁর নিজ প্রাসাদে নিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। মতিঝিলের ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র ভেঙে যায় এবং এরপর শওকতজঙ্গ পরাজিত ও নিহত হয়। সিরাজের তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার ফলে একটা বিপদের অবসান হয়।

ধৈর্যশীল: ষড়যন্ত্র তখন নতুন খাতে বইতে থাকে, বিজ্ঞ সিরাজ তখন ইংরেজদের অত্যাচারের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে তাঁর অমাত্যদের বিবেক ও স্বদেশপ্রেম জাগ্রত করার চেষ্টা করেন। সেই সঙ্গে তিনি দেখিয়ে দেন তাদের পরামর্শের ভ্রান্তি। কিন্তু নির্যাতিত লবণ-প্রস্তুতকারীকে উপস্থিত করার ব্যাপারটাকে তাঁরা তাঁদের প্রতি অপমান বলে গণ্য করে ক্ষুব্ধ হন। মিরজাফর প্রচ্ছন্ন ভীতি প্রদর্শন করতেও কুণ্ঠিত হন না। সিরাজ তাঁদের শিষ্ট আচরণের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন যে, দেশকে বাঁচাতে হলে সিপাহ্সালার, জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, উমিচাঁদ প্রমুখকে কয়েদখানায় আটক রাখা উচিত। তাঁর এ মন্তব্যে তাঁর বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণাই প্রকাশ পায়। কিন্তু ধৈর্যশীল ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নবাব একতাবদ্ধভাবে দেশের কল্যাণ প্রচেষ্টার পথ অনুসরণ করাকে শ্রেয় মনে করেন। তিনি ইংরেজদের বিদ্রোহমূলক কার্যকলাপের কথা উল্লেখ করে সন্দেহ-বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃত সম্প্রীতির ভিত্তিতে কল্যাণের পথে অগ্রসর হবার আহবান জানান। তিনি সেনাপতি ও অমাত্যদের কাছে তাঁকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বিভ্রান্ত না করারও অনুরোধ জানান।

দূরদর্শী: স্বার্থান্ধদের ষড়যন্ত্র অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। মিরজাফর মসনদ লাভের আকাক্সক্ষায় উন্মাদ হয়ে ওঠে। অন্যান্যরাও নিজ নিজ স্বার্থ হাসিল করতে বদ্ধ-পরিকর। মিরনের বাড়িতে দেশি ষড়যন্ত্রকারী ও বিদেশি ক্ষমতালিপ্সুদের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। নবাব সব খবরই রাখতেন। তিনি ইংরেজদের রাজধানী আক্রমণ করার সুযোগ না দিয়ে ইংরেজদের মোকাবেলা করার জন্য পলাশির প্রান্তরে শিবির স্থাপন করেন। মিরজাফর, রায়দুর্লভ প্রমুখ সেনাপতিরা তাঁর পক্ষে লড়বেন না জেনেও দূরদর্শী নবাব তাঁদের সাথে নিয়ে যান যাতে তাঁর অনুপস্থিতিতে রাজধানী দখল না করতে পারে। উল্লেখ্য যে, সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহের আশঙ্কায় তাঁদের পদচ্যুত করাও সম্ভব ছিল না।

দেশপ্রেমিক: নবাব ছিলেন অনন্যসাধারণ দেশপ্রেমিক। তাই তিনি আশা করতেন, দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন দেখে মিরজাফর, রায়দুর্লভ ও ইয়ার লুৎফ খাঁদের অন্তরে শেষ মুহূর্তে দেশপ্রেম জেগে উঠতে পারে। উচ্চ চিন্তার অধিকারী নবাব জানতেন না স্বার্থবোধ মানুষকে কত নিচে নামাতে পারে। নবাবের ক্ষীণ আশা পূর্ণ হয়নি। পলাশির প্রান্তরে যুদ্ধের অভিনয় হলো; মিরমর্দান, বদ্রী আলী প্রমুখ প্রাণ দিলেন, কিন্তু বিপর্যয় এড়ানো গেল না।

প্রবল মনোবল: চরম বিপর্যয়ের মুহূর্তেও নবাব আশা না হারিয়ে নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তৈরি হতে লাগলেন। অবিলম্বে মোহনলাল এসে পরাজয়ের খবর জানিয়ে নবাবকে মুর্শিদাবাদ ফিরে গিয়ে রাজধানী রক্ষা করার চেষ্টা করতে পরামর্শ দিলেন। তিনি দ্রুত ফিরে এসে জনগণকে দেশরক্ষায় উদ্বুদ্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাঁর সে চেষ্টা ব্যর্থ হলো। তখন তিনি পতিগত-প্রাণা লুৎফুন্নেসাকে সাথে নিয়ে রাজধানী ত্যাগ করলেন। ধৃত হয়ে বন্দিবেশে তাঁকে রাজধানীতে ফিরে আসতে হলো। ঘাতকের আঘাতে দেশের ও সাধ্বী-স্ত্রী লুৎফুন্নেসার কল্যাণের জন্য প্রার্থনা জানিয়ে কালেমা পড়তে পড়তে নবাব প্রাণ ত্যাগ করেন।

উপসংহার: নবাব চরিত্রে একটি মাত্রই দুর্বলতা দেখা যায় কিন্তু তাঁর উৎসও একটি মহৎ গুণ। এ দুর্বলতা হচ্ছে দয়া-মমতার আধিক্য। তিনি একটু কঠোর হতে পারলে হয়তো শেষ রক্ষা করতে পারতেন। তবে ষড়যন্ত্র ও স্বার্থপরতার বিরুদ্ধে তিনি যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন তাতে তার দক্ষতা, মানবিকতা, প্রজাদরদি ও নির্ভেজাল দেশপ্রীতির পরিচয় ফুটে উঠেছে।

1 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post