বিদ্যুৎ ও আধুনিক জীবন
[য. বো. ১৫, সি. বো. ১৩, কু. বো. ১১, ঢা. বো. ১১]
ভূমিকা: জ্ঞান-বিজ্ঞানের যেসব অগ্রগতি ও অবদানে আধুনিক সভ্যতা গড়ে উঠেছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগণ্য ভূমিকা নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানের। সব বাধা ও প্রতিকূলতাকে তুচ্ছ করে মানুষ অসাধ্যকে সাধন করে চলেছে; তা সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞানের কল্যাণেই।
আর সেই বিজ্ঞানের সোনার কাঠি হচ্ছে বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ বিজ্ঞান ও সভ্যতাকে পৌঁছে দিয়েছে উত্তরাধুনিক যুগে এবং জৈব প্রযুক্তির অসীম সম্ভাবনাময় যুগের দ্বারপ্রান্তে। বিদ্যুৎকে ছাড়া সভ্যতার সমস্ত গতি ও প্রযুক্তি নিমেষে থমকে যায়। আর সেই জন্যই বিদ্যুৎকে বলা হয় আধুনিক প্রযুক্তির ধাত্রী।
সভ্যতার অগ্রগতিতে বিদ্যুৎ: আজকের এ সভ্যতার গৌরবদীপ্ত মহিমা একদিনে গড়ে ওঠেনি। বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সভ্যতা আজ চরম সীমায় পৌঁছেছে। এ মহিমাদীপ্ত সভ্যতা বিজ্ঞানের দান। আর বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় উপকরণ বিদ্যুৎ হলো বর্তমান সভ্যতার চালিকাশক্তি। বলতে গেলে বর্তমান সভ্যতা বিদ্যুৎশক্তির ওপর নির্ভরশীল। বিদ্যুৎশক্তিকে বাদ দিয়ে আজকের দিনে মানুষের পক্ষে এক পা-ও চলা সম্ভব নয়। জীবনের বাঁকে বাঁকে প্রতিটি ক্ষেত্রে কলকারখানার উৎপাদনের জন্য, ঘরে আলো জ্বালানোর জন্য, গরম থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য নিত্যদিনের প্রায় সকল কাজই বিদ্যুতের সাহায্যে হয়ে থাকে।
আধুনিক জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য ও বিদ্যুৎ: আধুনিক জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যের মূলে বিদ্যুতের ভূমিকা অনন্য। দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে রয়েছে বিদ্যুতের অপরিহার্য ব্যবহার। সুইচ টিপলেই জ্বলে ওঠে আলো। সে আলোর এমনই শক্তি যে স্টেডিয়ামে রাতের বেলায় ফুটবল-ক্রিকেট খেলা যায়। প্রচণ্ড গরমে স্বাচ্ছন্দ্য আনে বৈদ্যুতিক পাখা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে বিদ্যুৎ শীতল পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে ঘরবাড়িতে, গাড়িতে, ট্রেনে, বাসে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় টেলিফোন, টেলিগ্রাফের মাধ্যমে বিপ্লবের সূচনা করেছে বিদ্যুৎ।
তারই সর্বাধুনিক উদ্ভাবন ই-মেইল, যা মুহূর্তেই পৃথিবীর অপর বিভিন্ন সঙ্গে যোগাযোগ ঘটিয়ে দিচ্ছে। বিদ্যুতের সাহায্যে মানুষ খাবার সংরক্ষণ করতে পারছে ফ্রিজে। শুনতে পারছে বেতার অনুষ্ঠান। মানুষের বিনোদন চাহিদা মেটাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বিদ্যুৎ। রিমোট টিপেই মানুষ ঘরে বসে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারছে। বিশ্ব চলে এসেছে মানুষের হাতের মুঠোয়। এভাবে আধুনিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্যের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ রাখছে অসামান্য অবদান।
শিল্পোৎপাদনে বিদ্যুৎ: দেশে দেশে আজ স্বল্প খরচে উৎপাদিত বিদ্যুৎকে কাজে লাগানো হচ্ছে শিল্পোৎপাদনে। বিশাল বিশাল সব যন্ত্রদানব আজ বিদ্যুৎশক্তির বলে পরিণত হয়েছে মানুষের ক্রীতদাসে। বৈদ্যুতিক তথা ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির সাহায্যে ঢেলে সাজানো হচ্ছে সারা বিশ্বের উৎপাদন-ব্যবস্থা। এর ফলে শিল্প ও কৃষি উৎপাদন বহু গুণে বেড়েছে। বিদ্যুতের সাহায্যেই গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক বিমান ও জাহাজ নির্মাণ শিল্প। বিশালাকৃতি যেসব জাহাজ সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিচ্ছে, যেসব ডুবোজাহাজ সমুদ্রতলে বিচরণ করছে সেগুলো চলছে বিদ্যুৎশক্তিতে। সভ্যতার পুরোভাগে যন্ত্রশিল্প যত বিকশিত হচ্ছে বিদ্যুতের ব্যবহারও ততই বাড়ছে।
এক নজরে দেখে নিন বোর্ড পরীক্ষার জন্য চূড়ান্ত সাজেশন্সসহ ৬০+ রচনা
চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিদ্যুতের অবদান: আজ মানুষের আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের যে বিস্ময়কর উন্নতি সাধিত হয়েছে তা সম্ভবপর হয়েছে বিদ্যুতের সাহায্যেই। দেহাভ্যন্তরে কোনো স্থান ব্যধিগ্রস্ত হলে যখন কোনো কিছুতেই রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হয় না তখন অনুমাননির্ভর চিকিৎসা না চালিয়ে এক্স-রে বা রঞ্জনরশ্মির সাহায্যে দেহাভ্যন্তরের ছবি তুলে রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে সঠিক চিকিৎসা করা সম্ভব হয়। এছাড়া, বৈদ্যুতিক-রশ্মির সাহায্যে ক্যান্সারের মতো নানা দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসাও করা হচ্ছে। তাছাড়াও রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে ইসিজি, কার্ডিওগ্রাফ ইত্যাদি। এগুলো চিকিৎসা জগতে বিপ্লব এনেছে। পঙ্গু, অসমর্থ ও মুমূর্ষু মানুষের জীবনে এনেছে আশার আলো।
মহাকাশ অভিযানে বিদ্যুৎ: মহাকাশ অভিযান ও মহাকাশ বিজয়ে মানুষের সমস্ত সাফল্যের মূলে বিদ্যুতের অবদান বিস্ময়কর। সূক্ষাতিসূক্ষ গণনা, নির্ভুল দিকস্থিতি নির্ণয়, পরিমিত তাপমাত্রা সংরক্ষণ এবং মহাকাশ অভিযানের হুবহু ছবি পৃথিবীতে প্রেরণ ইত্যাদির মতো অকল্পনীয় কাজ এখন বাস্তবে সম্পন্ন করতে সাহায্য করছে বিদ্যুৎ। গ্রহে-উপগ্রহে বিভিন্ন নভোযান ও স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণও চলছে বিদ্যুতের সাহায্যে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা (ঘঅঝঅ) সম্পূর্ণভাবে ইলেকট্র্রো-ম্যাগনেটিক প্রযুক্তিনির্ভর। বিদ্যুতের বিস্ময়কে কাজে লাগিয়ে প্রতিনিয়ত তারা আবিষ্কার করছে মহাকাশের অজানা দিগন্তকে।
তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ: এতকাল যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের দুটি অসামান্য অবদান ছিল টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ। এখন তাকেও ছাড়িয়ে গেছে বিদ্যুৎনির্ভর তথ্যপ্রযুক্তি। বর্তমানে কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ই-মেইল, মোবাইল ফোন, ফ্যাক্স ইত্যাদি বিদ্যুৎনির্ভর তথ্য ও যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষকে পরস্পরের এত কাছে নিয়ে এসেছে যে পৃথিবী পরিণত হয়েছে বিশ্বগ্রামে।
যাতায়াতের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ: যাতায়াত ব্যবস্থায় অভাবনীয় উন্নতি ও অগ্রগতি সাধন করছে বিদ্যুৎ। বৈদ্যুতিক ট্রেন ও পাতাল রেল দিনকে দিন আয়ত্ত করেছে অভাবনীয় গতি। বুলেট ট্রেন, বিলাসবহুল আরামপ্রদ এয়ারবাস ও সুপারসনিক বিমান পৃথিবীর এপ্রান্ত এবং ওপ্রান্তের দূরত্ব কমিয়ে দিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থায় এনেছে বিপ্লব।
বিদ্যুৎ ও বাংলাদেশ: বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে খুব দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছে দেশটি। এই ধারাকে বহমান রাখতে সবচেয়ে বেশি জরুরি পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ। কিন্তু অধিক জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক মেরুকরণ ও রাজনৈতিক অস্থিরতাপীড়িত বাংলাদেশের বিদ্যুতের ঘাটতি একটা বড় সমস্যা। এ ঘাটতি সমাধানে কিছু কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও বিদ্যুৎ ঘাটতি অব্যাহত রয়েছে এবং চাহিদা দিনকে দিন বাড়ছে। বাংলাদেশে অনুৎপাদনশীল খাতে বিদ্যুতের অপচয়ও একটা বড় সমস্যা। ফলে উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে থাকছি।
উপসংহার: সভ্যতা ও বিদ্যুৎ একে অপরের পরিপূরক। একটিকে বাদ দিলে তাই অপরটি হয় অর্থহীন ও নিষ্ফল। বিপদসংকুল এ পৃথিবীতে বিদ্যুতের সাহায্যেই মানুষ হয়ে উঠেছে বিপুল শক্তির অধিকারী; জল, স্থল ও অন্তরীক্ষের অধিপতি। বিদ্যুতের সাহায্যেই মানুষ এগিয়ে চলেছে কল্পনাতীত বাস্তবে। কিন্তু বিদ্যুতের আশীর্বাদ পৃথিবীর সব শ্রেণির লোক সমানভাবে লাভ করতে পারছে না।
এ কথা স্মরণে রাখতে হবে যে, বিজ্ঞানের রাজ্যে সবারই এতে সমান অধিকার। তাই বিদ্যুতের সহজলভ্য এবং এর অপরিমেয় শক্তিকে সর্বসাধারণের সেবায় উৎসর্গ করতে হবে।