G

ভারতীয় উপমহাদেশে ইউরোপীয় বনিকদের আগমন

ভারতীয় উপমহাদেশে ইউরোপীয় বনিকদের আগমনঃ

জলপথ আবিস্কারঃ ১৪৮৭ সালে পর্তূগীজ নবিক বার্থোলোমিউ দিয়াজ উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে পূর্বদিকে আসার পথ আবিস্কার করেন। ফলে ১৪৯৮ সালে ভাস্কো দা গামা ভারতের কালিকট বন্দরে দিয়াজের সহায়তায় আসেন এবং ভারবর্ষ আবিস্কার করেন।

পর্তুগীজদের আগমঃ ১৫১০ সালে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আসে। ১৫১৭ সালে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে চট্টগ্রাম ও সপ্তগ্রামে। ১০০ বছর তাদের বাণিজ্য একচেটিয়া ছিল।

ওলন্দাজদের আগমনঃ নেদারল্যাণ্ডের বাসিন্দারা ওলন্দাজ বা ডাচ নামে পরিচিত। ১৬০২ সালে তারা ‘ডাচ-ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী’ গঠন করে।

দিনেমারদের আগমনঃ ১৬১৬ সালে৬ডেনমার্কের লোকেরা ‘দিনেমার ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী’ গঠন করে। ১৮৪৫ সালে ইংরেজদের নিকট কুঠি বিক্রয় করে চলে যায়।

ইংরেজদের আগমনঃ ১৬০০ সালে তারা ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী গঠন করে। ১৬১২ সালে তারা সুরাটে কুঠি নির্মঅণ করে। ১৬৩৩ সালে শাহজাহান বঙ্গদেশে কুঠি নির্মাণের অনুমতি দেয়। ইংরেজরা পিপিলাই নামক গ্রামে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। ১৬৯০ সালে জব চার্নক কলকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রাম ক্রয় করে এবং তাদের রাজার নামানুসারে ‘ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ নির্মাণ করে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজরা জয়লাভ করে। ১৭৬৪ সালে চট্টগ্রাম, মেদিনীপুর ও বর্ধমান জেলা কোম্পানীকে হস্তান্তরের শর্তে মীর কাসিম নবাব হন। ঐ বছরই বক্সারের যুদ্ধ হয় এবং যুদ্ধে কাসিম পরাজিত হন। ১৭৬৪ সালে লর্ড ক্লাইভ বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করে বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে। প্রকৃতপক্ষে দিল্লীর সম্রাট শাহ আলম এই খাজনার বিনিময়ে বাংলার মুঘল অধিকার ইংরেজদের নিকট বিক্রি করে দেয়।

ফরাসীদের আগমনঃ ১৬৬৪ সালে ফরাসী বনিকগণ ‘ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী’ গঠন করে উপমহাদেশে আসে। বাংলার চন্দননগরে এবং চেন্নাইয়ের পন্ডিচেরীতে তারা কুটি তৈরী করে। ইংরেজদের সাথে প্রবল প্রতিদ্বন্দিতায় টিকতে না পেরে ১৭৬০ সালের পরে তারা ভারত ত্যাগ করে।
ভারতীয় উপমহাদেশে ইউরোপীয় বনিকদের আগমন

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ভারত শাসনঃ

নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর মীরজাফর বাংলার নবাব হন। তিনি ছিলেন নামমাত্র নবাব। প্রকৃত ক্ষমতা ছিল ইংরেজদের হাতে। ইংরেজরা ১৭৬০ সালে মীরজাফরকে সরিয়ে তার জামাতা মীর কাসিমকে বাংলার নবাবী দান করে। কিন্তু শীঘ্রই স্বাধীনচেতা মীর কাসিমের সাথে ইংরেজদের দ্বন্দ বাধে। অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা এবং দিল্লীর সম্রাট শাহ আলমের সহায়তা পাওয়া সত্ত্বেও মীর কাশিম ‘বক্সারের যুদ্ধে’ ইংরেজদের নিকট পরাজিত হন। লর্ড ক্লাইভ ১৭৬৫ সালে দ্বিতীয়বারের মত বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হলে বাংলায় সরাসরি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসন চালুর ব্যবস্থা করেন।

লর্ড ক্লাইভ ও দ্বৈত শাসন (১৭৬৫-১৭৬৭): ভারতবর্ষে ইংরেজ সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। ক্ষমতালোভী নবাব বংশধর ও অনুচরদের তুষ্ট রেখে কোম্পানীর আয় বৃদ্ধির জন্য তিনি বাংলায় দ্বৈত শাসনব্যবস্থা প্রচলন করেন। এ নীতি অনুযায়ী রাজস্ব আদায় ও দেশরক্ষার ভার কোম্পানীর হাতে রাখা হয় এবং শাসন বিভাগের ক্ষমতা নবাবের হাতে দেয়া হয়। এর মাধ্যমে রাজস্ব ব্যবস্থা হতে নবাবের কর্তৃত্ব খর্ব করা হয় এবং জনগণের উপর বিভিন্ন ধরনের কর আরোপের ফলে জনগণের দূর্ভোগ বৃদ্ধি পায়। এর প্রভাব হিসেবে পরবর্তীতে বাংলায় ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ সংঘটিত হয়। লর্ড ক্লাইভ বাংলার প্রথম ব্রিটিশ গভর্নর। গভর্নর নিযুক্ত হওয়ার পর ১৭৬৭ সালে তিনি বীরবেশে দেশে ফিরে যান।

গভর্নর কার্টিয়ার (১৭৬৯-১৭৭২): এ সময়ে সমগ্র বাংলায় দ্বৈত শাসনের প্রভাব পড়তে থাকে। দ্বৈত শাসনের প্রভাবে জনগণ ব্যাপক অর্থকষ্টের সম্মুখীন হয়। পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে বাংলা ১১৭৬ সালে (ইংরেজী ১৭৬৯-১৭৭০) বাংলায় ভয়াবহ দূর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়। ইতিহাসে এই দূর্ভিক্ষ ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে খ্যাত।

ওয়ারেন হেস্টিংস (১৭৭২-১৭৭৪, ১৭৭৪-১৭৮৪): কোম্পানীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি প্রথমেই দ্বৈত শাসনব্যবস্থা বিলুপ্ত করেন। তিনি মুঘল সম্রাটের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে মুঘল সম্রাটকে বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা কর প্রদান বন্ধ করে দেন। ভূমি রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে জমিদার শ্রেণী সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি পাঁচশালা ভূমি বন্দোবস্ত প্রতা চালু করেন।

লর্ড কর্ণওয়ালিশ (১৭৮৬-১৭৯৩, ১৮০৫): তিনি মারাঠা, নিযাম ও টিপু সুলতানের শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে সফল হন। রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি এবং স্থায়ী অনুরক্ত শ্রেণী সৃষ্টির মানসে তিনি দশশালা বূমি বন্দোবস্তা প্রথা চালু করেন। ১৭৯৩ সালের ২২ মার্চ তিনি ‘চিরস্থায়ী বন্দাবস্তা’ প্রথা চালুর মাধ্যমে ‘সূর্যাস্ত আইন’ বলবৎ করেন। একই সালে হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের জন্য সহমরণ বিষয়ক ‘সতীদাহ প্রথা’ প্রবর্তন করেন।

লর্ড ওয়েলেসলি ( ১৭৯৮-১৮০৫): ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারে উগ্র প্রচেষ্টার জন্য সবিশেষ পরিচিতি লাভ করেন। তিনি ছিলেন প্রথম সাম্রাজ্যবাদী বড়লাট। তিনি ‘অধীনতামূলক মিত্রতা’ নীতি প্রবর্তন করেন।

লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক (১৮২৮-১৮৩৫): তার শাসনামল উপমহাদেশে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষা সংস্কারের জন্য বিখ্যাত। সংস্কারের অংশ হিসেবে তিনি ভারতীয়দের জন্য ‘সাব জজ’ ও ‘মুন্সেফ’ পদ সৃষ্টি করেন।
 
রাজা রামহোহনের সহায়তায় ১৮২৯ সালে তিনি ‘সতীদাহ প্রথা’ বাতিল করেন। ১৮৩৫ সালে তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। একই সালে তিনি ‘ম্যাকলে শিক্ষানীতি’ প্রণয়ন করেন।

লর্ড হেনরি হার্ডিঞ্জ (১৮৪৪-১৮৪৮): ভারতবর্ষের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিশেষত বেল যোগাযোগে তিনি ব্যাপক অবদান রাখেন। তিনি শিখদের যুদ্ধে পরাজিত করেন এবং এককোটি টাকা জরিমানা আদায়ের জন্য গোলাপ সিং নামে এক ব্যক্তির নিকট ৭৫ লক্ষ টাকায় জম্মু ও কাশ্মীর বিক্রয় করেন।

লর্ড ডালহৌসী (১৮৪৮-১৮৫৬): সাম্রাজ্যবাদী গভর্নর হিসেবে তিনি ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিলেন। তিনি স্বত্ব বিলোপ নীতি প্রবর্তন করেন। তার উগ্র সাম্রাজ্যবাদী নীতির কারণে দেশীয় বিভিন্ন গোত্র ও আঞ্চলিক শক্তি ইংরেজদের উচ্ছেদ করার সংকল্প করতে থাকেন যা পরবর্তীতে সিপাহী বিপ্লবের দিকে ভারতবর্ষকে ঠেলে দেয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্রঅসাগরের সহায়তায় ১৮৫৬ সালে তিনি বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়ন করেন।

লর্ড ক্যানিং (১৮৫৬-১৮৫৭): তিনি শেষ গভর্নর জেনারেল। এসময় ইংরেজদের দাসত্ব হতে মুক্তিলাভের জন্য বিখ্যাত ‘সিপাহী বিপ্লব’ (১৮৫৭ সাল) সংঘটিত হয়। তিনি কাগজের মুদ্রা প্রচলন করেন।

সিপাহী বিপ্লবঃ

২৬ জানুয়ারী-১৮৫৭ প্রথম দমদমে বিদ্রোহ দেখা দেয়। ২৯ মার্চ-১৮৫৭ ব্যারাকপুরের সেনা ছাউনিতে ‘মঙ্গল পান্ডে’ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং শহীদ হন। সিপাহী বিদ্রোহে তিনি প্রথম শহীদ হন। সিপাহীরা দিল্লী দখল করে শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে স্বাধীন ভারতের ‘বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করেন। ঢাকায় সিপাহী বিপ্লব সংঘটিত হয় সিপাহী রজব আলীর নেতৃত্বে। বিদ্রোহীদের প্রধান সেনাপতি ছিলেন পেশোয়া বাজীরাওয়ের পোষ্যপুত্র ধন্ধপন্থ (নানা সাহেব)। ব্রিটিশ সেনানায়ক মেজর হাডসন দিল্লী দখল করে সম্রাট বাহাদুর শাহকে গ্রেফতার করে রেঙ্গুনে নির্বাসন দেন। ১৮৫৮ সালের ৭ জুলাই ইংরেজরা শান্তি ঘোষনা করে।

ইস্ট ইন্ডিয়া যুগের অবসানঃ

১৮৫৭ সালে মহারানী ভিক্টোরিয়ার ঘোষণার ফলে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনের অবসান ঘটে। এই আইনে বলা হয়, এখন থেকে ব্রিটিশ রাজা ও রানীর পক্ষে মন্ত্রিসভার কোনো এক সদস্য ব্রিটিশ ভারতের শাসনভার গ্রহণ করবেন। তার উপাধি হয় ভারত সচিব। তখন থেকে গর্ভনর জেনারেল পদবি ভাইসরয়ে রূপান্তিরিত হয়। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের আইন দ্বারা কোম্পানির হাত থেকে ব্রিটিশ সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ ছিল একটি নামফলক বদল মাত্র।

No comments:

Post a Comment