G

বাংলা গল্প 'আত্মচরিত' -ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

[লেখক-পরিচিতিঃ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ শে সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তীর পিতার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতার নাম ভগবতী দেবী। তার বংশ পদবি বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর তাঁর উপাধি। ঈশ্বরচন্দ্র নিজ গ্রামে পাঠশালার পাঠ শেষে আট বছর বয়সে পিতার সঙ্গে কলকাতায় আসেন। সেখানে শিবচরণ মল্লিকের বাড়ির পাঠশালায় এক বছর অধ্যয়ন সম্পন্ন করে তিনি ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। এ কলেজে নিরবচ্ছিন্ন বারো বছর অধ্যয়ন করে তিনি ব্যাকরণ, কাব্য, অলংকার, বেদান্ত, স্মৃতি, ন্যায় ও জ্যোতিষশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন।

সকল পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে লাভ করেন 'বিদ্যাসাগর" উপাধি। তিনি ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগে হেড পন্ডিত হিসেবে যোগদান করেন। পরে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত হন। পরে সরকার কর্তৃক বিশেষ বিদ্যালয় পরিদর্শক নিযুক্ত হলে তারই তত্ত্বাবধানে কুড়িটি মডেল স্কুল ও পঁয়ত্রিশটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। নিজ অর্থ ব্যয়ে মেট্রোপলিটন কলেজ (অধুনা বিদ্যাসাগর কলেজ) স্থাপন তাঁর অনন্য কীর্তি।

গল্পঃ
আত্মচরিত
ঈশ্বরচন্দ্রই প্রথম গদ্যে যতিচিহ্নের যথাযথ ব্যবহার করে বাংলা গদ্যে শৃঙ্খলা আনয়ন করেন তাকে বলা হয় বাংলা গদ্যের প্রথম শিল্পী। শিক্ষকতা ছাড়াও সমাজ সংস্কার ও মুক্তচিন্তার প্রচার ও প্রসারে তাঁর অবদান তুলনারহিত। সমাজে বিধবাবিবাহ ও নারীশিক্ষার প্রচলনে এবং বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক অভিশাপ দূরীকরণে পঞ্চবিংশতি'। এছাড়া “সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা”, “বর্ণ পরিচয় (১ম ও ২য় ভাগ)”, "শকুন্তলা", “সীতার বনবাস", "আখ্যানমঞ্জুরী", ভ্রান্তিবিলাস" তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ শে জুলাই কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।]

বীরসিংহ গ্রামে আমার জন্ম হয়। আমি জনক জননীর প্রথম সন্তান। বীরসিংহের আধ ক্রোশ অন্তরে, কোমরগঞ্জ নামে এক গ্রাম আছে; এ গ্রামে, মঙ্গলবারে ও শনিবারে, মধ্যাহৃসময়ে হাট বসিয়া থাকে। আমার জন্মসময়ে পিতৃদেব বাটীঁতে ছিলেন না; কোমরণঞ্জে হাট করিতে গিয়াছিলেন। পিতামহদেব তাঁহাকে আমার জন্মসংবাদ দিতে যাইতেছিলেন; পথিমধ্যে, তাহার সহিত সাক্ষাৎ হইলে, বলিলেন, “একটি এঁড়ে বাছুর হইয়াছে” এই সময়ে, আমাদের বাটীতে, একটি গাই গর্ভিণী ছিল; তাহারও আজ কাল, প্রসব হইবার সম্ভাবনা।

এইচএসসি (HSC) বোর্ড পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির জন্য পড়ুন সৃজনশীল এবং বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও উত্তরসহ: 

এজন্য, পিতামহদেবের কথা শুনিয়া, পিতৃদেব মনে করিলেন, গাইটি প্রসব হইয়াছে। উভয়ে বাটীতে উপস্থিত হইলেন। পিতৃদেব, এঁড়ে বাছুর দেখিবার জন্য, গোয়ালের দিকে চলিলেন। তখন পিতামহদেব হাস্যমুখে বলিলেন, “ও দিকে নয়, এ দিকে এস; আমি তোমায় এঁড়ে বাছুর দেখাইয়া দিতেছি।” এই বলিয়া, সৃতিকাগৃহে লইয়া গিয়া, তিনি এঁড়ে বাছুর দেখাইয়া দিলেন।
আত্মচরিত - ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা ১ম পত্র একাদশ - দ্বাদশ শ্রেণি
লেখকঃ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
এই অকিঞ্চিৎকর কথার উল্লেখের তাৎপর্য এই যে, আমি বাল্যকালে, মধ্যে মধ্যে, অতিশয় অবাধ্য হইতাম। প্রহার ও তিরস্কার দ্বারা, পিতৃদেব আমার অবাধ্যতা দূর করিতে পারিতেন না। ঐ সময়ে, তিনি, সন্নিহিত ব্যক্তিদের নিকট, পিতামহদেবের পূর্বোক্ত পরিহাসবাক্যের উল্লেখ করিয়া, বলিতেন, "ইনি সেই এঁড়ে বাচুর; বাবা পরিহাস করিয়াছিলেন, বটে; কিন্তু, তিনি সাক্ষাৎ ঋষি ছিলেন; তাহার পরিহাসবাক্যও বিফল হইবার নহে; বাবাজি আমার, ক্রমে, এঁড়ে গরু অপেক্ষাও একগুঁইয়া হইয়া উঠিতেছেন |”...

পিতৃদেব ঠাকুরদাসের বয়ঃক্রম যখন ১৪/১৫ বৎসর, তখন তিনি মাতৃদেবীর অনুমতি লইয়া, উপার্জনের চেষ্টায়, কলিকাতা প্রস্থান করিলেন। ঠাকুরদাস, প্রথমত বনমালিপুরে, তৎপরে বীরসিংহে, সংক্ষিপ্তসার ব্যাকরণ পড়িয়াছিলেন। কিন্তু, যে উদ্দেশে তিনি কলিকাতায় আসিয়াছিলেন, সংস্কৃতপাঠে নিযুক্ত হইলে, তাহা সম্পন্ন হয় না।...

যাহা হউক, অনেক বিবেচনার পর, অবশেষে ইহাই অবধারিত হইল, যাহাতে তিনি শীঘ্র উপার্জনক্ষম হন, সেরূপ পড়াশুনা করাই কর্তব্য।

এই সময়ে, মোটামুটি ইংরেজি জানিলে, সওদাগর সাহেবদিগের হৌসে, অনায়াসে কর্ম হইত। এজন্য, সংস্কৃত না পড়িয়া, ইংরেজি পড়াই, তাঁহার পক্ষে, পরামর্শসিদ্ধ স্থির হইল। কিন্তু, সে সময়ে, ইংরেজি পড়া সহজ ব্যাপার ছিল না। তখন, এখনকার মত, প্রতি পল্লিতে ইংরেজি বিদ্যালয় ছিল না। তাদৃশ বিদ্যালয় থাকিলেও, তাহার ন্যায় নিরুপায় দীন বালকের তথায় অধ্যয়নের সুবিধা ঘটিত না।

যাহা হউক, একই ব্যক্তির আশ্রয়ে আসিয়া, ঠাকুরদাসের, নির্বিগ্নে, দুই বেলা আহার ও ইংরেজি পড়া চলিতে লাগিল। কিছুদিন পরে, ঠাকুরদাসের দুর্ভাগ্যক্রমে, তদীয় আশ্রয়দাতার আয় বিলক্ষণ খর্ব হইয়া গেল; সুতরাং, তাহার নিজের ও তাহার আশ্রিত ঠাকুরদাসের, অতিশয় কৃষ্ট উপস্থিত হইল।...

এক দিন, মধ্যাহৃসময়ে, ক্ষুধায় অস্থির হইয়া, ঠাকুরদাস বাসা হইতে বহির্গত হইলেন, এবং অন্যমনস্ক হইয়া, ক্ষুধার যাতনা ভুলিবার অভিপ্রায়ে, পথে পথে ভ্রমণ করিতে লাখিলেন। কিঞ্চিৎ পরেই, তিনি এক দোকানের সম্মুখে উপস্থিত ও দণ্ডায়মান হইলেন; দেখিলেন, এক মধ্যবয়স্কা বিধবা নারী এ দোকানে বসিয়া মুড়ি মুড়কি বেচিতেছেন।...

ঠাকুরদাস, তৃষ্ণার উল্লেখ করিয়া, পানার্থে জল প্রার্থনা করিলেন। তিনি, সাদর ও সস্নেহ বাক্যে, ঠাকুরদাসকে বসিতে বলিলেন, এবং ব্রাহ্মণের ছেলেকে শুধু জল দেওয়া অবিধেয়, এই বিবেচনা করিয়া, কিছু মুড়কি ও জল দিলেন; ঠাকুরদাস, যেরূপ ব্যগ্র হইয়া, মুড়কিগুলি খাইলেন, তাহা এক দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করিয়া, ঐ স্ত্রীলোক জিজ্ঞাসা করিলেন, বাপাঠাকুর, আজ বুঝি তোমার খাওয়া হয় নাই?

তিনি বলিলেন, না, মা আজ আমি এখন পর্যন্ত, কিছুই খাই নাই। তখন সেই স্ত্রীলোক ঠাকুরদাসকে বলিলেন, বাপাঠাকুর, জল খাইও না, একটু অপেক্ষা কর এই বলিয়া, নিকটবর্তী গোয়ালার দোকান হইতে, সত্বর দই কিনিয়া আনিলেন, এবং আরও মুড়কি দিয়া, ঠাকুরদাসকে পেট ভরিয়া ফলার করাইলেন; পরে, তাঁহার মুখে সবিশেষ সমস্ত অবগত হইয়া, জিদ করিয়া বলিয়া দিলেন, যে দিন তোমার এরূপ ঘটিবেক, এখানে আসিয়া ফলার করিয়া যাইবে।

পিতৃদেবের মুখে এই হৃদয়বিদারণ উপাখ্যান শুনিয়া, আমার অন্তঃকরণে যেমন দুঃসহ দুঃখানল প্রজ্বলিত হইয়াছিল, স্ত্রীজাতির উপর তেমনই প্রগাঢ় ভক্তি জন্মিয়াছিল।

কিছু দিন পরে, ঠাকুরদাস, আশ্রয়দাতার সহায়তায়, মাসিক দুই টাকা বেতনে কোনও স্থানে নিযুক্ত হইলেন। এই কর্ম পাইয়া, তাঁহার আর আহ্লাদের সীমা রহিল না। পূর্ব আশ্রয়দাতার আশ্রয়ে থাকিয়া, আহারের ক্লেশ সহ্য করিয়াও বেতনের দুইটি টাকা, যথানিয়মে, জননীর নিকট পাঠাইতে লাগিলেন।

দুই-তিন বৎসর পরেই, ঠাকুরদাস মাসিক পাচ টাকা বেতন পাইতে লাগিলেন। তখন তাঁহার জননীর ও ভাইভগিনীগুলির, অপেক্ষাকৃত অনেক অংশে, কষ্ট দূর হইল।

এই সময়ে, ঠাকুরদাসের বয়ঃক্রম তেইশ-চব্বিশ বৎসর হইয়াছিল। অতঃপর তাঁহার বিবাহ দেওয়া আবশ্যক বিবেচনা করিয়া, তর্কভুষণ মহাশয় গোঘাটনিবাসী তর্কবাগীশের দ্বিতীয়া কন্যা ভগবতীদেবীর সহিত, তাহার বিবাহ দিলেন। এই ভগবতীদেবীর গর্ভে আমি জন্মগ্রহণ করিয়াছি।

আমার যখন জ্ঞানোদয় হইয়াছে, মাতৃদেবী, পুত্রকন্যা লইয়া, মাতুলালয়ে যাইতেন, এবং এক যাত্রায়, ক্রমান্বয়ে, পাচ-ছয় মাস বাস করিতেন কিন্তু একদিনের জন্যেও, স্নেহ, যত্ন ও সমাদরের ত্রুটি হইত না। বস্তুত, ভাগিনেয়ী ও ভাগিনেয়ীর পুত্রকন্যাদের উপর এরুপ স্নেহপ্রদর্শন অদৃষ্টচর ও অশ্রুতপূর্ব ব্যাপার। জ্যেষ্ঠা ভাগিনেয়ীর মৃত্যু হইলে, তদীয় একবর্ষীয় দ্বিতীয় সন্তান, বিংশতি বৎসর বয়স পর্যন্ত, আদ্যন্ত অবিচলিতস্নেহে, প্রতিপালিত হইয়াছিলেন।

আমি পঞ্চমবর্ষীয় হইলাম। বীরসিংহে কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পাঠশালা ছিল।। গ্রামস্থ বালকগণ ঐ পাঠশালায় বিদ্যাভ্যাস করিত। আমি তাঁহার পাঠশালায় প্রেরিত হইলাম। চট্টোপাধ্যায় মহাশয় সাতিশয় পরিশ্রমী এবং শিক্ষাদানবিষয়ে বিলক্ষণ নিপুণ ও সবিশেষ যত্নবান ছিলেন। ইহার পাঠশালার ছাত্রেরা, অল্প সময়ে উত্তমরূপ শিক্ষা করিতে পারিত, এজন্য, ইনি উপযুক্ত শিক্ষক বলিয়া, বিলক্ষণ প্রতিপত্তিলাভ করিয়াছিলেন।...

পাঠশালায় এক বৎসর শিক্ষার পর আমি ভয়ঙ্কর জ্বররোগে আক্রান্ত হইয়াছিলাম। আমি এ যাত্রা রক্ষা পাইব, প্রথমত এরূপ আশা ছিল না। কিছু দিনের পর, প্রাণনাশের আশঙ্কা নিরাকৃত হইল; একবারে বিজ্বর হইলাম না। অধিক দিন জ্বরভোগ করিতে করিতে, প্লীহার সঞ্চার হইল। জ্বর ও প্লীহা উভয় সমবেত হওয়াতে শীঘ্র আরোগ্যলাভের সম্ভাবনা রহিল না। ছয় মাস অতীত হইয়া গেল; কিন্তু, রোগের নিবৃত্তি না হইয়া, উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই হইতে লাগিল।

জননীদেবীর জ্যেষ্ঠ মাতুল, রাধামোহন বিদ্যাভূষণ আমার পীড়াবৃদ্ধির সংবাদ পাইয়া বীরসিংহে উপস্থিত হইলেন এবং দেখিয়া শুনিয়া সাতিশয় শঙ্কিত হইয়া আমাকে আপন আলয়ে লইয়া গেলেন। মাতুলের সন্নিকটে কোটরীনামে যে গ্রাম আছে, তথায় বৈদ্যজাতীয় উত্তম উত্তম চিকিৎসক ছিলেন; তাহাদের অন্যতমের হস্তে আমার চিকিৎসার ভার অর্পিত হইল। তিন মাস চিকিৎসার পর, সম্পূর্ণ আরোগ্যলাভ করিলাম। এই সময়ে, আমার উপর, বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের ও তদীয় পরিবারবর্গের স্নেহ ও যত্নের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শিত হইয়াছিল।

কিছু দিন পরে বীরসিংহে প্রতিপ্রেরিত হইলাম এবং পুনরায় কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় পাঠশালায় প্রবিষ্ট হইয়া, আট বৎসর বয়স পর্যন্ত তথায় শিক্ষা করিলাম। আমি গুরুমহাশয়ের প্রিয়শিষ্য ছিলাম। আমার বিলক্ষণ স্মরণ হইতেছে, পাঠশালার সকল ছাত্র অপেক্ষা, আমার উপর তাহার অধিকতর স্নেহ ছিল। আমি তাহাকে অতিশয় ভক্তি ও শ্রদ্ধা করিতাম।...

পিতামহদেব, রামজয় তর্কভূবণ, অতিসার রোগে আক্রান্ত হইয়া ছিয়াত্তর বৎসর বয়সে দেহত্যাগ করিলেন। তিনি নিরতিশয় তেজস্বী ছিলেন; কোনও অংশে, কাহারও নিকট অবনত হইয়া চলিতে অথবা কোনও প্রকারে অনাদর বা অবমাননা সহ্য করিতে পারিতেন না। তিনি, সকল স্থলে, সকল বিষয়ে, স্বীয় অভিপ্রায়ের অনুবর্তী হইয়া চলিতেন, অন্যদীয় অভিপ্রায়ের অনুবর্তন, তদীয় স্বভাব ও অভ্যাসের অস্পূর্ণ বিপরীত ছিল। উপকার-প্রত্যাশায়, অথবা অন্য কোনও কারণে, তিনি কখনও পরের উপাসনা বা আনুগত্য করিতে পারেন নাই। তাঁহার স্থির সিদ্ধান্ত ছিল, অন্যের উপাসনা বা আনুগত্য করা অপেক্ষা প্রাণত্যাগ করা ভালো। তিনি নিতান্ত নিস্পৃহ ছিলেন, এজন্য, অন্যের উপাসনা বা আনুগত্য, তাঁহার পক্ষে, কস্মিন কালেও আবশ্যক হয় নাই।

তর্কভূষণ মহাশয় নিরতিশয় অমায়িক ও নিরহঙ্কার ছিলেন। কি ছোট, কি বড়, সর্ববিধ লোকের সহিত, সমভাবে সদয় ও সাদর ব্যবহার করিতেন। তিনি যাঁহাদিগকে কপটবাচী মনে করিতেন, তাহাদের সহিত সাধ্যপক্ষে আলাপ করিতেন না। তিনি স্পষ্টবাদী ছিলেন, কেহ রুষ্ট বা অসন্তুষ্ট হইবেন, ইহা ভাবিয়া, স্পষ্ট কথা বলিতে ভীত বা সঙ্কুচিত হইতেন না। তিনি যেমন স্পষ্টবাদী, তেমনই যথার্থবাদী ছিলেন। কাহারও ভয়ে, বা অনুরোধে, অথবা অন্য কোনও কারণে, তিনি, কখনও কোনও বিষয়ে অযথা নির্দেশ করেন নাই। তিনি যাঁহাদিগকে আচরণে ভদ্র তাহাদিগকে ভদ্রলোক বলিয়া গণ্য করিতেন; আর যাঁহাদিগকে আচরণে অভদ্র দেখিতেন, বিদ্বান, ধনবান ও ক্ষমতাপন্ন হইলেও, তাহাদিগকে ভদ্রলোক বলিয়া জ্ঞান করিতেন না।

তর্কভূষণ মহাশয় অতিশয় বলবান, নিরতিশয় সাহসী, এবং সর্বতোভাবে অকুতোভয় পুরুষ ছিলেন। এক লৌহদন্ড তাঁহার চিরসহচর ছিল; উহা হস্তে না করিয়া তিনি কখনও বাটীর বাহির হইতেন না। তৎকালে পথে অতিশয় দস্যুভয় ছিল। স্থানান্তরে যাইতে হইলে, অতিশয় সাবধান হইতে হইত। অনেক স্থলে, কি প্রত্যুষে, কি মধ্যাহ্নে, কি সায়াহ্নে, অল্পসংখ্যক লোকের প্রাণনাশ অবধারিত ছিল। এজন্য, অনেকে সমবেত না হইয়া, এ সকল স্থল দিয়া যাতায়াত করিতে পারিতেন না। কিন্তু তর্কভুষণ মহাশয়, অসাধারণ বল, সাহস ও চিরসহচর লৌহদণ্ডের সহায়তায় সকল সময়ে এ সকল স্থল দিয়া একাকী নির্ভয়ে যাতায়াত করিতেন। দস্যুরা দুই-চারি বার আক্রমণ করিয়াছিল। কিন্তু উপযুক্তরূপ আক্কেলসেলামি পাইয়া, আর তাহাদের তাহাকে আক্রমণ করিতে সাহস হইত না। মনুষ্যের কথা দূরে থাকুক, বন্য হিংস্র জন্তুকেও তিনি ভয়ানক জ্ঞান করিতেন না।

পিতামহদেবের দেহাত্যয়ের পর পিতৃদেব আমায় কলিকাতায় আনা স্থির করিলেন। তদনুসারে, ১২৩৫ সালের কার্তিক মাসের শেষভাগে, আমি কলিকাতায় আনীত হইলাম ... বড়বাজারনিবাসী ভাগবতচরণ সিংহ পিতৃদেবকে আশ্রয় দিয়াছিলেন। তদবধি তিনি তদীয় আবাসেই অবস্থিতি করিতেছিলেন। যে সময়ে আমি কলিকাতায় আনীত হইলাম, তাহার অনেক পূর্বে সিংহ মহাশয়ের দেহাত্যয় ঘটিয়াছিল। এক্ষণে তদীয় একমাত্র পুত্র জগদ্দুর্লভ সিংহ সংসারের কর্তা। এই সময়ে জগদ্দুর্লভবাবুর বয়ঃক্রম পঁচিশ বৎসর | গৃহিণী, জ্যেষ্ঠা ভগিনী, তাহার স্বামী ও দুই পুত্র, এক বিধবা কনিষ্ঠা ভগিনী ও তাহার এক পুত্র, এইমাত্র তাহার পরিবার। জগদ্দুর্লভবাবুর  পিতৃদেবকে পিতৃব্যশব্দেসম্ভাষণ করিতেন; সুতরাং আমি তাহার ও তাহার ভগিনীদিগের ভ্রাতৃস্থানীয় হইলাম। তাঁহাকে দাদা মহাশয়, তাঁহার ভগিনীদিগকে, বড় দিদি ও ছোট দিদি বলিয়া সম্ভাষণ করিতাম।

এই পরিবারের মধ্যে অবস্থিত হইয়া পরের বাটীতে আছি বলিয়া, এক দিনের জন্যেও আমার মনে হইত না। সকলেই যথেষ্ট স্লেহ করিতেন। কিন্তু কনিষ্ঠা ভগিনী রাইমণির অদ্ভুত স্নেহ ও যত্ন, আমি, কস্মিন কালেও বিস্মৃত হইতে পারিব না। তাঁহার একমাত্র পুত্র গোপালচন্দ্র ঘোষ আমার প্রায় সমবয়স্ক ছিলেন। পুত্রের উপর জননীর যেরূপ স্নেহ ও যত্ব থাকা উচিত ও আবশ্যক, গোপালচন্দ্রের উপর রাইমণির শ্রেহ ও যত্ন তদপেক্ষা অধিকতর ছিল, তাহার সংশয় নাই। কিন্তু আমার আন্তরিক দৃঢ় বিশ্বাস এই স্নেহ ও যত্ন বিষয়ে আমার ও গোপালে রাইমণির অণুমাত্র বিভিন্নভাব ছিল না।

ফলকথা এই, স্নেহ, দয়া, সৌজন্য, অমায়িকতা, সদ্বিবেচনা প্রভৃতি সদগুণ বিষয়ে রাইমণির সমকক্ষ স্ত্রীলোক এ পর্যন্ত আমার নয়নগোচর হয় নাই। এই দয়াময়ীর সৌম্যমূর্তি, আমার হৃদয়মন্দিরে, দেবীমূর্তির ন্যায়, প্রতিষ্ঠিত হইয়া, বিরাজমান রহিয়াছে। প্রসঙ্গক্রমে, তাহার কথা উত্থাপিত হইলে, তদীয় অপ্রতিম গুণের কীর্তন করিতে করিতে, অশ্রুপাত না করিয়া থাকিতে পারি না। আমি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী বলিয়া, অনেকে নির্দেশ করিয়া থাকেন। আমার বোধ হয়, সে নির্দেশ অসঙ্গত নহে। যে ব্যক্তি রাইমণির স্নেহ, দয়া, সৌজন্য প্রভৃতি প্রত্যক্ষ করিয়াছে এবং এ সমস্ত সদগুণের ফলভোগী হইয়াছে, সে যদি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী না হয়, তাহা হইলে, তাহার তুল্য কৃতঘ্ন পামর ভূমন্ডলে নাই।

আমি পিতামহীদেবীর একান্ত প্রিয় ও নিতান্ত অনুগত ছিলাম। কলিকাতায় আসিয়া, প্রথমত কিছু দিন, তাহার জন্য, যার পর নাই, উৎকন্ঠিত হইয়াছিলাম। সময়ে সময়ে, তাহাকে মনে করিয়া কাঁদিয়া ফেলিতাম। কিন্তু দয়াময়ী রাইমণির স্নেহ ও যত্নে আমার সেই বিষম উৎকন্ঠা ও উৎকট অসুখের অনেক অংশে নিবারণ হইয়াছিল।

এই সময়ে, পিতৃদেব, মাসিক দশ টাকা বেতনে, জোড়াসাঁকোনিবাসী রামসুন্দর মল্লিকের নিকট নিযুক্ত ছিলেন। বড়বাজারের চকে মল্লিক মহাশয়ের এক দোকান ছিল। এ দোকানে লোহা ও পিতলের নানাবিধ বিলাতি জিনিস বিক্রি হইত। যে সকল খরিদ্দার ধারে জিনিস কিনিতেন, তাহাদের নিকট হইতে পিতৃদেবকে টাকা আদায় করিয়া আনিতে হইত। প্রতিদিন, প্রাতে এক প্রহরের সময় কর্মস্থানে যাইতেন; রাত্রি এক প্রহরের সময় বাসায় আসিতেন। এ অবস্থায় অন্যত্র বাসা হইলে, আমার মত পল্লিগ্রামের অষ্টমবর্ষীয় বালকের পক্ষে, কলিকাতায় থাকা কোনও মতে চলিতে পারিত না।

গুরুমহাশয়ের পাঠশালায় যতদূর শিক্ষা দিবার প্রণালী ছিল, কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের ও স্বরূপচন্দ্র দাসের নিকট আমার সে পর্যন্ত শিক্ষা হইয়াছিল। অতঃপর কিরূপ শিক্ষা দেওয়া উচিত, এ বিষয়ে পিতৃদেবের আত্মীয়বর্গ, স্ব স্ব ইচ্ছার অনুযায়ী পরামর্শ দিতে লাগিলেন। শিক্ষাবিষয়ে আমার কিরূপ ক্ষমতা আছে, এ বিষয়ের আলোচনা হইতে লাগিল। সেই সময়ে, প্রসঙ্গক্রমে, পিতৃদেব মাইলস্টোনের উপাখ্যান বলিলেন। সে উপাখ্যান এই-

প্রথমবার কলিকাতায় আসিবার সময়, সিয়াখালায় সালিখার বাঁধা রাস্তায় উঠিয়া, বাটনাবাটা শিলের মতো একখানি প্রস্তর রাস্তার ধারে পোঁতা দেখিতে পাইলাম। কৌতূহলাবিষ্ট হইয়া, পিতৃদেবকে জিজ্ঞাসিলাম, বাবা, রাস্তার ধারে শিল পোঁতা আছে কেন। তিনি, আমার জিজ্ঞাসা শুনিয়া, হাস্যমুখে কহিলেন, ও শিল নয়, উহার নাম মাইলস্টোন। আমি বলিলাম, বাবা, মাইলস্টোন কী, কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। তখন তিনি বলিলেন, এটি ইংরেজি কথা, মাইল শব্দের অর্থ আধ ক্রোশ; স্টোন শব্দের অর্থ পাথর; এই রাস্তার আধ আধ ক্রোশ অন্তরে, এক একটি পাথর পোঁতা আছে; উহাতে এক, দুই, তিন প্রভৃতি অঙ্ক খোদাই করা রহিয়াছে। এই পাথরের অঙ্ক উনিশ; ইহা দেখিলেই লোকে বুঝিতে পারে এখান হইতে কলিকাতা উনিশ মাইল অর্থাৎ, সাড়ে নয় ক্রোশ। এই বলিয়া, তিনি আমাকে ঐ পাথরের নিকট লইয়া গেলেন।

নামতায় 'একের পিঠে নয় উনিশ' ইহা শিথিয়াছিলাম | দেখিবামাত্র আমি প্রথমে এক অঙ্কের, তৎপরে নয় অঙ্কের উপর হাত দিয়া বলিলাম, তবে এটি ইংরেজির এক আর এইটি ইংরেজির নয়। অনন্তর বলিলাম, তবে বাবা, ইহার পর যে পাথরটি আছে, তাহাতে আঠার, তাহার পরটিতে সতর, এইরূপে ক্রমে ক্রমে এক পর্যন্ত অঙ্ক দেখিতে পাইব। তিনি বলিলেন, আজ দুই পর্যন্ত অঙ্ক দেখিতে পাইবে, প্রথম মাইলস্টোন যেখানে পোঁতা আছে, আমরা সে দিক দিয়া যাইব না। যদি দেখিতে চাও, একদিন দেখাইয়া দিব। আমি বলিলাম, সেটি দেখিবার আর দরকার নাই; এক অঙ্ক এইটিতেই দেখিতে পাইয়াছি। বাবা, আজ পথে যাইতে যাইতেই আমি ইংরেজির অঙ্কগুলি চিনিয়া ফেলিব।

এই প্রতিজ্ঞা করিয়া, প্রথম মাইলস্টোনের নিকটে গিয়া, আমি অস্কগুলি দেখিতে ও চিনিতে আরম্ভ করিলাম। মনবেড় চটিতে দশম মাইলস্টোন দেখিয়া পিতৃদেবকে সম্ভাষণ করিয়া বলিলাম, বাবা, আমার ইংরেজি অঙ্ক চিনা হইল পিতৃদেব বলিলেন, কেমন চিনিয়াছ, তাহার পরীক্ষা করিতেছি। এই বলিয়া, তিনি নবম, অষ্টম, সপ্তম, এই তিনটি মাইলস্টোন ক্রমে ক্রমে দেখাইয়া জিজ্ঞাসিলেন, আমি এটি নয়, এটি আট, এটি সাত, এইরূপে

বলিলাম। পিতৃদেব ভাবিলেন, আমি যথার্থই অঙ্কগুলি চিনিয়াছি, অথবা নয়ের পর আট, আটের পর সাত অবধারিত আছে, ইহা জানিয়া, চালাকি করিয়া নয়, আট, সাত বলেতেছি। যাহা হউক, ইহার পরীক্ষা করিবার নিমিস্ত, কৌশল করিয়া তিনি আমাকে ষষ্ঠ মাইলস্টোনটি দেখিতে দিলেন না; অনন্তর, পঞ্চম মাইলস্টোনটি দেখাইয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, এটি কোন মাইলস্টোন, বল দেখি। আমি দেখিয়া বলিলাম, বাবা, এই মাইলস্টোনটি খুদিতে ভুল হইয়াছে; এটি ছয় হইবেক, না হইয়া পাঁচ খুদিয়াছে।

এই কথা শুনিয়া পিতৃদেব ও তাহার সমভিব্যাহারীরা অতিশয় আহ্লাদিত হইয়াছেন, ইহা তাহাদের মুখ দেখিয়া স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম। বীরসিংহের গুরুমহাশয় কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ও এ সমভিব্যাহারে ছিলেন৷ তিনি আমার চিবুকে ধরিয়া “বেস বাবা বেস" এই কথা বলিয়া, অনেক আশীর্বাদ করিলেন এবং পিতৃদেবকে সম্বোধিয়া বলিলেন, দাদা মহাশয়, আপনি ঈশ্বরের লেখাপড়া বিষয়ে যত্ন করিবেন। যদি বাঁচিয়া থাকে, মানুষ হইতে পারিবেক। যাহা হউক, আমার এই পরীক্ষা করিয়া, তাহারা সকলে যেমন আহ্লাদিত হইয়াছিলেন, তাহাদের আহ্লাদ দেখিয়া, আমিও তদনুরূপ আহ্লাদিত হইয়াছিলাম।

মাইল স্টোনের উপাখ্যান শুনিয়া, পিতৃদেবের পরামর্শদাতা আত্নীয়েরা একবাক্য হইয়া, "তবে ইহাকে রীতিমত ইংরেজি পড়ান উচিত" এই ব্যবস্থা স্থির করিয়া দিলেন। কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে সিদ্ধেশ্বরীতলার ঠিক পূর্বদিকে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় ছিল। উহা হের সাহেবের স্কুল বলিয়া প্রসিদ্ধ ৷ পরামর্শদাতারা এ বিদ্যালয়ের উল্লেখ করিয়া বলিলেন, উহাতে ছাত্রেরা বিনা বেতনে শিক্ষা পাইয়া থাকে এ স্থানে ইহাকে পড়িতে দাও; যদি ভালো শিখিতে পারে বিনা বেতনে হিন্দু কালেজে পড়িতে পাইবেক: হিন্দু কালেজে পড়িলে ইংরেজির চূড়ান্ত হইবেক। আর যদি তাহা না হইয়া উঠে, মোটামুটি শিখিতে পারিলেও, অনেক কাজ দেখিবেক, কারণ, মোটামুটি ইংরেজি জানিলে, হাতের লেখা ভালো হইলে ও যেমন তেমন জমাখরচ বোধ থাকিলে, সওদাগর সাহেবদিগের হৌসে ও সাহেবদের বড় বড় দোকানে অনায়াসে কর্ম করিতে পারিবেক।

আমরা পুরুষানুক্রমে সংস্কৃতব্যবসায়ী; পিতৃদেব অবস্থার বৈগুণ্যবশত ইচ্ছানুরূপ সংস্কৃত পড়িতে পারেন নাই; ইহাতে তাঁহার অন্তঃকরণে অতিশয় ক্ষোভ মন্মিয়াছিল। তিনি সিদ্ধান্ত করিয়া রাখিয়াছিলেন, আমি রিতিমত সংস্কৃত শিখিয়া চতুষ্পাঠীতে অধ্যাপনা করিব। এজন্য পূর্বোক্ত পরামর্শ তাহার মনোনীত হইল না। তিনি বলিলেন, উপার্জনক্ষম হইয়া, আমার দুঃখ ঘুচাইবেক, আমি সে উদ্দেশ্যে ঈশ্বরকে কলিকাতায় আনি নাই। আমার একান্ত অভিলাষ, সংস্কৃত শাস্ত্রে কৃতবিদ্য হইয়া দেশে চতুষ্পাঠী করিবেক, তাহা হইলেই আমার সকল ক্ষোভ দূর হইবেক। এই বলিয়া, তিনি আমার ইংরেজি স্কুলে প্রবেশ বিষয়ে, আন্তরিক অসম্মতি প্রদর্শন করিলেন। তাহারা অনেক পীড়াপীড়ি করিলেন, তিনি কিছুতেই সম্মত হইলেন না।

মাতৃদেবীর মাতুল রাধামোহন বিদ্যাভূষণের পিতৃব্যপুত্র মধুসূদন বাচস্পতি সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করিতেন। তিনি পিতৃদেবকে বলিলেন, আপনি ঈশ্বরকে সংস্কৃত কালেজে পড়িতে দেন, তাহা হইলে, আপনকার অভিপ্রেত সংস্কৃত শিক্ষা সম্পন্ন হইবেক; আর যদি চাকরি করা অভিপ্রেত হয়, তাহারও বিলক্ষণ সুবিধা আছে; সংস্কৃত কালেজে পড়িয়া, যাহারা ল কমিটির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, তাহারা আদালতে জজপন্ডিত্যের পদে নিযুক্ত হইয়া থাকে। অতএব, আমার বিবেচনায়, ঈশ্বরকে সংস্কৃত কালেজে পড়িতে দেওয়াই উচিত। চতুষ্পাঠী অপেক্ষা কালেজে রীতিমত সংস্কৃত শিক্ষা হইয়া থাকে। বাচস্পতি মহাশয় এই বিষয় বিলক্ষণ রূপে পিতৃদেবের হদয়লম করিয়া দিলেন। অনেক বিবেচনার পর, বাচস্পতি মহাশয়ের ব্যবস্থাই অবলম্বনীয় স্থির হইল।
[সংক্ষিপ্ত পাঠ]


শব্দার্থ ও টীকাঃ
ক্রোশ - দূরত্ব পরিমাপের একক। দুই মাইলের চেয়ে কিছু বেশি।
নিরাকৃত - নিরাকরণ। দূরীকরণ।
বিজ্বর - জ্বরমুক্ত।
অতিসার - উদরাময়। পেটের পীড়াবিশেষ।
অনুবর্তন - অনুসরণ। অনুগমন।
কপটবাচী - কপট বা মিথ্যা কথা বলে যে।
আক্কেলসেলামি - মূর্খতার জন্য প্রাপ্ত শাস্তি।
দেহাত্যয় - দেহত্যাগ। মৃত্যু |
সৌম্যমূর্তি - প্রসন্ন বা প্রশান্ত মূর্তি।
কৃতঘ্ন - উপকারীর অপকার করে যে।
পামর - পাপিষ্ঠ। নরাধম।
সমভিব্যাহারী - একত্রে অবস্থানকারী। সঙ্গী।
হৌস - সওদাগরি দপ্তর বা অফিস।

পাঠ-পরিচিতিঃ
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আত্মজীবনীমূলক বর্ণনাধর্মী অসমাপ্ত রচনার নাম 'আত্মচরিত" সংকলিত অংশে তাঁর শৈশব জীবনের কথা বিধৃত হয়েছে। এ রচনায় ঈশ্বরচন্দ্র তার পিতা, পিতামহ ও জননীর কথা বর্ণনা করেছেন। বিষয় অনুসারে গদ্যের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে তার সহজাত শক্তিমত্তার প্রকাশ ঘটেছে বর্তমান রচনায়। কৌতুকবোধ, নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও মমতা এবং পাঠকের বোধগম্য করার অভিপ্রায়ে যথার্থ বিরামচিহ্ন ব্যবহার বর্তমান রচনার বিশিষ্ট প্রান্ত। ঈশ্বরচন্দ্র শৈশবকালে ছিলেন ডানপিটে। পাঁচ বছর বয়সে গ্রামের পাঠশালায় তাকে ভর্তি করা হয় এবং আট বছর বয়স পর্যন্ত সেখানে অধ্যয়ন করেন। তার পিতামহ রামজয় তর্কভূষণের মৃত্যুর পর, পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় অর্থোপার্জনের নিমিত্তে কলকাতায় পাড়ি জমান, তখন বালক ঈশ্বরচন্দ্রও পিতার হাত ধরে শহরে আসেন। কলকাতায় যাবার প্রাক্কালে, রাস্তার পাশে “বাটনাবাটা শিলের মতো" প্রস্তর বা মাইলস্টোন দেখে বালক ঈশ্বরচন্দ্র খুবই কৌতূহলী হয়ে ওঠেন এবং তার পিতৃদেবের সহায়তায় পাথরের গায়ে খোদিত ইংরেজি অঙ্কগুলো অতি দ্রুত শিখে নেন। বালকের অভাবিত মেধাশক্তির পরিচয় পেয়ে তার পিতা ও অন্য সহগামীবৃন্দ বিস্ময়াভিভূত হন; তখন কেউ কেউ ঠাকুরদাসকে পরামর্শ দেন, ঈশ্বরচন্দ্রকে যেন ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করা হয়, কারণ ইংরেজি ভাষা ভালো জানা থাকলে “সাহেবদিগের হৌসে ও সাহেবদের বড় বড় দোকানে" কাজ পাওয়া সহজ হবে। কিন্তু ঠাকুরদাস এসব পরামর্শ কানে নেননি।

বহুনির্বাচনি পশ্নঃ
১. “আত্মচরিত” রচনাটিতে কে স্পষ্টবাদী?
ক. কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় 
খ. রাধামোহন বিদ্যাভুষণ
গ. রামজয় তর্কভূষণ 
ঘ. ভাগবতচরণ সিংহ

২. কোন গুণের কারণে কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়কে উপযুক্ত শিক্ষক বলা যায়?
ক. আগ্রহের জন্য 
খ. সদিচ্ছার জন্য
গ. যত্নশীলতার জন্য 
ঘ. প্রশিক্ষণের জন্য

নিচের উদ্দীপকটি পড়ে ৩ ও ৪ সংখ্যক প্রশ্নের উত্তর দাও।
মেঘনা গ্রামের অপু কাজের সন্ধানে ঢাকায় এসে বংশালের সাইকেল ব্যবসায়ী কাদের সাহেবের কাছে আশ্রয় নিলেন। গ্রামের স্কুলটি তেমন ভালো নয় বলে তিনি পুত্র উপলকে মালিকের বাসায় এনে রাখেন। মালিকের বোন রুমা অপত্য স্নেহ দিয়ে উপলকে দেখাশুনা করতে লাগলেন। উপল একাকিত্ব ও গ্রামের স্মৃতি ভুলে সেখানে দিনাতিপাত করতে লাগল। এই সান্নিধ্যের কারণে উপল নারীর প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠে।

৩. উদ্দীপকের রুমা "আত্মচরিত" রচনার কোন চরিত্রের সঙ্গে তুলনীয়?
ক. গৃহিণীর 
খ. জ্যেষ্ঠ ভগিনীর
গ. কনিষ্ঠা ভগিনীর 
ঘ. পিতামহীদেবীর

৪. উক্ত চরিত্রটির মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে-
i. জননীর স্নেহ
ii. দায়িত্ব বোধ
iii. মমত্ব

নিচের কোনটি ঠিক?
ক. i ও ii 
খ. ii ও iii
গ. iও iii 
ঘ. i, ii ও iii

এইচএসসি (HSC) বোর্ড পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির জন্য পড়ুন সৃজনশীল এবং বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও উত্তরসহ:  বাংলা ১ম পত্র গাইড

সৃজনশীল প্রশ্নঃ
বাকাল গ্রামের মন্দিরের পুরোহিত দ্বিজেন্দ্রনাথ তার পুত্র দিনেশকে টোল অর্থাৎ সংস্কৃত পাঠশালায় পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। গ্রামবাসী তাকে বোঝালেন, এ শিক্ষা শেষে সব ধরনের চাকরি পাওয়া সম্ভব নয়। সাধারণ শিক্ষার পাঠ গ্রহণ করলে শিক্ষার দিগন্ত ও জ্ঞানার্জনের পথ বিস্তৃত হয় এবং চাকরির ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়। দ্বিজেন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত দিনেশকে সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাকাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করলেন।
ক. বড় বাজারের চকে মল্লিক মহাশয়ের কিসের দোকান ছিল? ১
খ. ঈশ্বরচন্দ্রকে কেন ইংরেজি পড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল তা ব্যাখ্যা কর। ২
গ. “দ্বিজেন্দ্রনাথের সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্রের পিতার সাদৃশ্য আছে।"- ব্যাখ্যা কর। ৩
ঘ. “দিনেশ ও ঈশ্বরচন্দ্র একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন”-“আত্মচরিত" অবলম্বনে মূল্যায়ন কর। ৪

1 comment: