G

ধ্বনি পরিবর্তন বলতে কি বোঝায়? বিস্তারিত আলোচনা

বাংলা ব্যাকরণ
আলোচ্য বিষয়ঃ
ধ্বনি পরিবর্তন

স্বরাগমঃ উচ্চারণকে সহজতর করার জন্য শব্দের স্বরধ্বনির আগমনকে স্বরাগম বলে।

আদি স্বরাগমঃ শব্দের আদিতে বা শুরুতে স্বরধ্বনির আগমন ঘটলে তাকে আদি স্বরগম বলে। যেমন-
স্ত্রী>ই + স্ত্রী=ইস্ত্রী, স্কুল>ই + স্কুল= ইস্কুল, স্টিমার>ই + স্টিমার= ইস্টিমার। এরূপ-আস্তাবল, অস্পর্ধা ইস্টিশন ইত্যাদি।

মধ্য স্বরাগমঃ উচ্চারণের সুবিধার জন্য সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনির মাঝখানে বা শব্দের  মাঝখানে স্বরধ্বনির আগমন ঘটলে তাকে মধ্য স্বরাগম বলে। যেমন- 
অ-রত্ন>রতন, ধর্ম>ধরম, স্বপ্ন>স্বপন, হর্ষ>হরষ।
ই-প্রীতি>পিরীত, ফিল্ম>ফিলিম, ডাল>ডাইল।
উ-ভ্রু>ভুরু, চাল>চাউল।
এ-স্রেফ>সেরেফ।

অন্ত্য স্বরাগমঃ উচ্চরণের সময় শব্দের শেষে স্বরধ্বনি আসলে তাকে অন্ত্য স্বরাগম বলে। যেমন-
দিশ>দিশা, পোখত>পোক্ত, সত্য>সত্যি
সম্প্রকর্ষ বা স্বরলোপঃ দ্রুত উচ্চরণের জন্য শব্দের কোন স্বরধ্বনি লোপকে সম্প্রকর্ষ বলে। যেমন-
বসতি>বসতি, জানালা>জানলা

আদি স্বরলোপঃ অলাব>লাবু>লাউ, উদ্বার>উধার>ধার।

মধ্য স্বরলোপঃ অগুরু>অগ্রু, সুবর্ণ>স্বর্ণ, গৃহিণী>গিন্নী।

অন্ত্য স্বরলোপঃ অগ্নি>আগুন, চারি>চার

অপিনিহিতিঃ কোন শব্দের মধ্যকার স্বরধ্বনি যদি যথাস্থানে উচ্চারিত না হয়ে পুর্বে উচ্চারিত হয় তবে তাকে অপনিহিতি বলে।
যেমন-আজি>আইজ, সাধু>সাউধ

অভিশ্রুতিঃ অপিনিহিতি শব্দের স্বরধ্বনিগুলো পরিবর্তিত হয়ে যদি শব্দটি নতুন রূপ ধারণ করে তবে তাকে অভিশ্রুতি বলে।
অন্য কথায়, অপিনিহিতি শব্দের মধ্যস্থিত ই বা উ উচ্চারণকালে পূর্ববর্তী স্বরধ্বনির সাথে মিলিত হয়ে যে ধ্বনি পরিবর্তন ঘটে তাকে অভিশ্রুতি বলে।
মূল শব্দ অপিনিহিত শব্দ অভিশ্রুতি
করিয়া        > কইর‌্যা       > করে
আজি         > আইজ       > আজ
আসিয়া       > আইস্যা      > এসে
সকল সাধুভাষার ক্রিয়াপদ অভিশ্রুতির মাধ্যমে চলিতরূপ লাভ করে।

স্বরসঙ্গতিঃ এক স্বরের প্রভাবে অন্য স্বরের পরিবর্তন ঘটলে তাকে স্বরসঙ্গতি বলে। যেমন-
দেশি >দিশি, বিলাতি >বিলিতি, বুড়া >বুড়ো।

প্রগত স্বরসঙ্গতিঃ আদি স্বরের প্রভাবে পরবর্তী স্বর পরিবর্তিত হলে তাকে প্রগত স্বরসঙ্গতি বলে। যেমন-
মুলা >মুলো, শিকা >শিকি।

পরাগত স্বরসঙ্গতিঃ পরবর্তী স্বরের প্রভাবে আদিস্বরের পরিবর্তন হলে তাকে পরাগত স্বরসঙ্গতি বলে। যেমন-
দেশি >দিশি, আখো >এখো।

মধ্যগত স্বরসঙ্গতিঃ আদিস্বর অথবা অন্ত্যস্বর অনুযায়ী মধ্যস্বর পরিবর্তিত হলে মধ্যগত স্বরসঙ্গতি হয়। যেমন-
বিলাতি >বিলিতি।

অন্যোন্য স্বরসঙ্গতিঃ আদ্য এবং অন্ত্য উভয় র্স্বই পরস্পর প্রভাবিত হয়ে পরিবর্তিত হলে তাকে অন্যান্য স্বরসঙ্গতি বলে। যেমন-
মোজা >মুজো।

ধ্বনি বিপর্যয়ঃ শব্দের মধ্যকার দুটো ব্যঞ্জন বর্ণের পরস্পরের মধ্যে যদি স্থান পরিবর্তন ঘটে তবে তাকে ধ্বনি বিপর্যয় বলে। যেমন-
পিশাচ >পিচাশ, বাকস >বাসক, রিকসা >রিসকা, জানালা >জালানা।

বিষমীভবনঃ পদ মধ্যস্থিত দুটি সমবর্ণের মধ্যে একটি পরিবর্তিত হলে তাকে বিষমীভবন বলে। যেমন-
শরীর>শরীল, লাল>নাল।

সমীভবনঃ শব্দ মধ্যস্থিত দুটো ভিন্ন ধ্বনি একে অপরের প্রভাবে অল্পবিস্তর সমতা লাভ করে, ধ্বনি পরিবর্তনের এ রীতিকে বলা হয় সমীভবন। যেমন-
চক্র>চক্ক, পদ্ম>পদ্দ, লগ্ন>লগগ, কাঁদনা>কান্না।

প্রগত সমীভবনঃ পরবর্তী ধ্বনির প্রভাবে পূর্ববর্তী ধ্বনির পরিবর্তন ঘটলে প্রগত সমীভবন বলে। যেমন- 
চক্র>চক্ক, পদ্ম>পদ্দ।

পরাগত সমীভবনঃ পরবর্তী ধ্বনির প্রভাবে পূর্ববর্তী ধ্বনির পরিবর্তন হলে পরাগত সমীভবন বলে। যেমন- 
তৎ + জন্য>তজ্জন্য, তৎ + হিত>তদ্বিত, উৎ + মুখ>উন্মুখ।

অন্যান্য সমীভবনঃ যখন পরস্পরের প্রভাবে দুটো ধ্বনিই পরিবর্তিত হয় তখন তাকে অন্যান্য সমীভবন বলে। যেমন-
সংস্কৃত সত্য>প্রাকৃত সচ্ছ, সংস্কৃত বিদ্যা>প্রাকৃত বিজ্জা ইত্যাদি। 

অসমীকরণঃ একই স্বরের পুনরাবৃত্তি দূর করার জন্য মাঝখানে স্বরধ্বনি যুক্ত হলে তাকে অসমীকরণ বলে। যেমন- ধপ + ধপ>ধপাধপ, টপ + টপ>টপাটপ।

ধ্বনি পরিবর্তন | বাংলা ব্যাকরণ লেকচার শীট

স্বরধ্বনির উচ্চারণ
ধ্বনির অবস্থানভিত্তিক

অ: শব্দে অবস্থানভেদে অ দু রকমে লিখিত হয়
 ১) স্বাধীন ভাবে ব্যবহৃত অ। যেমন - অমর, অনেক।
২) শব্দের মধ্যে অন্য বর্ণের সঙ্গে বিলীন ভাবে ব্যবহৃত অ। যেমন - কর, বল। এখানে ক এবং র আর ব এবং ল বর্ণের সঙ্গে অ বিলীন  হয়ে আছে। (ক্ + অ +র্  + অ ; ব্ + অ + ল্ + অ) ।

শব্দের অ - ধ্বনির দু রকম উচ্চারণ পাওয়া যায়
 ১) বিবৃত বা স্বাভাবিক উচ্চারণ। যেমন - অমল, অনেক, কত।
 ২) সংবৃত বা ও - ধ্বনির মত উচ্চারণ। 
যথা - অধীর, অতুল, মন। এ উচ্চারণগুলোতে অ-এর উচ্চারণ  অনেকটা ও-এর মত (ওধীর, ওতুল, মোন)।'

১) ‘অ’ - ধ্বনির স্বাভাবিক বা বিবৃত উচ্চারণ

 (ক) শব্দের আদিতে
 ১) শব্দের আদিতে না-বোধক ‘অ’ যেমন - অটল, অনাচার।
২) ‘অ’ কিংবা ‘আ’ - যুক্ত ধ্বনির পূর্ববর্তী অ-ধ্বনি বিবৃত হয়। যেমন - অমানিশা, অনাচার, যত, কথা।

খ) শব্দের মধ্যে ও অন্তে
১) পূর্ব স্বরের সঙ্গে মিল রেখে স্বরসঙ্গতির কারণে বিবৃত ‘অ’। যেমন - কলম, যত, ।
২) ঋ-ধ্বনি, এ-ধ্বনি ঐ-ধ্বনি ও-ধ্বনি এবং ঔ-ধ্বনির পরবর্তী ‘অ’ প্রায়ই বিবৃত হয়। 
 যেমন-তৃণ, দেব, ধৈর্য, নোলক, বৈধতা, শ্রেয়ঃ, মৌন অনেক।
৩) অনেক সময় ই-ধ্বনির পরের ‘অ’ বিবৃত হয়। যেমন - গঠিত, মিত, জনিত ইত্যাদি।

২) অ-ধ্বনির সংবৃত উচ্চারণ
অ-ধ্বনির বিবৃত উচ্চারণে চোয়াল বেশি ফাঁক হয়। ঠোঁট তত বাঁকা বা গোল হয় না। কিন্তু সংবৃত উচ্চারণে চোয়ালের ফাঁক কম ও ঠোঁট গোলাকৃতি হয়ে ‘ও’ - এর মত উচ্চারিত হয়। সংবৃত উচ্চারণকে ‘বিকৃত’, ‘অপ্রকৃত’ বা ’অস্বাভাবাবিক’ উচ্চারণ বলা ঠিক নয়। সংবৃত উচ্চারণও ‘স্বাভাবিক’, ‘অবিকৃত’ ও ‘প্রকৃত’ উচ্চারণ।

 (ক) শব্দের আদিতে
 ১) পরবর্তী স্বর সংবৃত হলে শব্দের আদি ‘অ’ সংবৃত হয়। যেমন- অতি (ওতি), করুণ (কোরুণ) করে (অসমাপিকা ‘কোরে’)। কিন্তু  সমাপিকা ‘করে’ শব্দের ‘অ’ বিবৃত।
২) পরবর্তী ই,উ - ইত্যাদির প্রভাবে পূর্ববর্তী র - ফলাযুক্ত ‘অ’ সংবৃত হয়। যেমন - প্রতিভা, (প্রোতিভা), প্রচুর (প্রোচুর) ইত্যাদি। কিন্তু,  অ, আ ইত্যাদির প্রভাবে পূর্ব ‘অ’  বিবৃত হয়। যেমন - প্রভাত,প্রত্যয়, প্রণাম ইত্যাদি।

 
(খ) শব্দের মধ্যে ও অন্তে
১) তর, তম, তন প্রত্যয়যুক্ত বিশেষণ পদের অন্ত্য স্বর ‘অ’ সংবৃত হয়। যেমন - প্রিয়তম (প্রিয়তমো), গুরুতর (গুরুতরো) ইত্যাদি।
২) ই, ঈ, উ, ঊ-এর পরবর্তী মধ্য ও অন্ত্য ‘অ’ সংবৃত। যেমন - পিয়, (পিয়ো), যাবতীয় (যাবতীয়ো) ইত্যাদি।

আঃ বাংলায় আ-ধ্বনি একটি বিবৃত স্বর। এর উচ্চারণ হ্রস্ব ও দীর্ঘ দু-ই হতে পারে। এর উচ্চারণ অনেকটা ইংরেজি ফাদার (father) ও কাম (calm) শব্দের আ (ধ) - এর মত। যেমন - আপন, বাড়ি, মা, দাতা ইত্যাদি।
বাংলায় একাক্ষর (monosyllabic) শব্দে আ দীর্ঘ হয়। যেমন- কাজ শব্দের আ দীর্ঘ এবং কাল শব্দের আ হ্রস্ব। এ রূপ - যা, পান, ধান, সাজ, চাল, চাঁদ, বাঁশ। 

এঃ এ-ধ্বনির উচ্চারণ দু রকম : সংবৃত ও বিবৃত। যেমন- মেঘ, সংবৃত/বিবৃত, খেলা-(খ্যালা), বিবৃত।

১) সংবৃতঃ
ক)পদের অন্তে ‘এ’ সংবৃত হয়। যেমন - পথে, ঘাটে, দোষে, গুণে, আসে ইত্যাদি।
খ)তৎসম শব্দের প্রথমে ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে যুক্ত এ - ধ্বনির উচ্চারণ সংবৃত হয়। যেমন - দেশ, প্রেম, শেষ ইত্যাদি।
  গ) একাক্ষর সর্বনাম পদের ‘এ’ সংবৃত হয়। যেমন- কে, সে, যে।
ঘ) ‘হ’ কিংবা আকার বিহীন যুক্তধ্বনি পরে থাকলে ‘এ’ সংবৃত হয়। যেমন - দেহ, কেহ, কেষ্ট।
ঙ) ‘ই’ বা ‘উ’-কার পরে থাকলে ‘এ’ সংবৃত হয়। যেমন - দেখি, রেণু, বেলুন।

২) বিবৃতঃ ‘এ’ ধ্বনির বিবৃত উচ্চারণ ইংরেজি ক্যাট (cat) ও ব্যাট (bat) -এর ‘এ’ (a)-এর মত। 
 যেমন - দেখ (দ্যাখ), একা (এ্যাকা) ইত্যাদি।
 এ - ধ্বনির এই বিবৃত উচ্চারণ কেবল শব্দের আদিতেই পাওয়া যায়, শব্দের মধ্যে ও অন্তে পাওয়া যায় না। 
 ক) দু অক্ষর বিশিষ্ট সর্বনাম বা অব্যয় পদে- যেমনঃ এত, এখন, হেন, কেন ইত্যাদি। কিন্তু ব্যতিক্রম -যেথা,  সেথা, হেথা।
 খ) অনুস্বার ও চন্দ্রবিন্দু যুক্ত ধ্বনির আগের - এ ধ্বনি বিবৃত। যেমন - খেংড়া, চেংড়া, স্যাঁতসেতে, গেঁজেল।
 গ) খাঁটি বাংলা শব্দেঃ যেমন - খেমটা, ঢেপসা, তেলাপোকা, তেনা, দেওর।
 ঘ) এক, এগার, তের - এ কটি সংখ্যাবাচক শব্দে, ‘এক’ যুক্ত শব্দেওঃ যেমন- এক চোট, এক তলা, এক ঘরে  ইত্যাদি।
 ঙ) ক্রিয়াপদের বর্তমান কালের অনুজ্ঞায়, তুচ্ছার্থ ও সাধারণ মধ্যম পুরুষের রূপে; যেমন- দেখ্ (দ্যাখ),  দেখ  (দ্যাখো),  খেল্ (খ্যাল), খেল খ্যালো), ফেল্ (ফ্যাল্), ফেল (ফ্যালো) ইত্যাদি। 

বিগত সালের প্রশ্নাবলি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১. ধরিয়া থেকে ধরে ধ্বনি পরিবর্তনের কোন নিয়মে হয়েছে?
[ ঘ ইউনিট-২০১৮-১৯]
ক. অন্তহীত
খ. অভিশ্রুতি✓
গ. সমীভবন
ঘ. স্বরসঙ্গতি

২. শুনিয়া > শুনে কোন ধরনের ধ্বনি পরিবর্তন?
[ ঘ ইউনিট-২০১৮-১৯]
ক. বিধমীভবন
খ. সমীভবন
গ. স্বরলোপ
ঘ. অভিশ্রুতি✓

৩. কোনটি একাক্ষর শব্দ?
[ ঘ ইউনিট-২০১৭-১৮]
ক. কাকা
খ. চাচা
গ. ভাই✓
ঘ. বোনাই

৪.. ধার শব্দটি যে ধ্বনি পরিবর্তন প্রক্রিয়ার দৃষ্টান্ত-
[ খ ইউনিট-২০১৭-১৮]
ক. বিপ্রকর্ষ
খ. স্বরভক্তি
গ. সম্প্রকর্ষ✓
ঘ. অন্তর্হতি

৫. ট্যাক্স> ট্যাকসো এটি ধ্বনির কোন ধরনের পরিবর্তন?
[ ঘ ইউনিট-২০১৭-১৮]
ক. অন্ত্য স্বরাগম✓
খ. অভিশ্রুতি
গ. ধ্বনি বিপর্যয়
ঘ. মধ্য স্বরাগম

৬. মোজ> মুজো এটি কোন ধরনের স্বরসঙ্গতি?
[ খুবি খ ইউনিট-২০১৮-১৯]
ক. প্রগত
খ. পরাগত
গ. মধ্যগত
ঘ. অন্যেন্য✓
 
বাংলা ২য় পত্র লেকচার শীট: সন্ধি

No comments:

Post a Comment